হৃদয়ের নিকুঞ্জ নিড়ে- গল্পকন্যার ধারাবাহিক প্রেমের গল্প ( পর্ব-০৫ ) |
হৃদয়ের নিকুঞ্জ নিড়ে- পর্বঃ ০৪ পড়ুন
৫.
মেয়েটি পিছু ফিরে রাতকে দেখে বলে,"এতো খুশির কি আছে,প্রেম করার জন্য নাম্বার দেয়েছি নাকি!"
তারপর থেকে শুরু হলো দুজনের ফোনে কথোপকথন।
যে ইফরাত ছিলো ভ্রমনপিপাসু,চট্টগ্রামের অলিগলি ঘুরে ঘুরে ফেমাস সব খাবার খেতে পছন্দ করতো, সেই ইফরাত এখন প্যারেট গ্রাউন্ডে প্রতিদিন চার বার চক্কর কাটে।জিমে যায়,ফুল ডায়েট করে আর মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করে।আরো একটা কাজ নিয়মিত করে,তা হলো পাপড়ির সাথে প্রতিদিন কথা বলে।যার ব্যতিক্রম হলে রাতের নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়।
দুজনের মধ্যে বেশ ভালো বন্ধুত্ত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠেছে।পাপড়ির কাছে সম্পর্কটা নিতান্তই বন্ধুর মতো হলেও রাতের মনে দিন দিন ভালোবাসার রং গাঢ় হচ্ছে।
________________
সন্ধ্যা তখন ছুঁই ছুঁই।
পাখিরা যার যার নিড়ে ফেরার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।কাটাপাহাড়ের রাস্তাটা ভিষণ নিরব হয়ে আছে।অন্য দিন যদিও দুই একটা রিক্সা,সিএনজির দেখা মিলতো,কিন্তু আজকে তাও নেই।পাপড়ির মনে হচ্ছে ওর পিছনে কেউ একজন আছে।কিন্তু ঘুড়ে দাঁড়ালে কাউকেই দেখতে পায় না।এখন অনেকটা ভয় কাজ করছে,বেশ কিছুদিন যাবত-ই ওর এমন মনে হচ্ছে।
সামনে তাকাতেই দূর থেকে কেউ আসতে দেখছে ।
তা দেখে মনে কিছুটা সাহস সঞ্চয় হয়েছে।এ মুহূর্তে কিছুক্ষণ আগের পরিস্থিতির কথা ভেবে ওর নিজের কাছে নিজেকে হাসির পাত্র মনে হচ্ছে,এক রকম বিরক্ত লাগছে।
"গত তিনটা বছরে ও বুঝতে পেরেছে এক একা একটা মেয়ের জীবন যাপন করা কতোটা কষ্টকর।এই সমাজে একা বাঁচতে হলে একটা মেয়েকে কতটা লড়াই করতে হয়।কতো ঝড় ঝাঁপটা পেরোতে হয়।কারণে অকারণে র্যাগ দেয়া সিনিয়রদের ভিরে,ভার্সিটিতে নানানরকম রাজনৈতিক কর্মকান্ডের ভিরে,ও একাকী এখনো এ ভার্সিটিতে টিকে আছে।অনেক কাটখোট্টা পেড়িয়ে এখন তৃতীয় বর্ষে উঠতে পেরেছে।শুরুটা মোটেই ওর জন্য সহজ ছিলো না।আর এক দের বছরের মধ্যে ওর নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ব্যবস্থা হয়ে যাবে।" এসব ভাবতে ভাবতে ছেলে দুটোর সামনে চলে এসেছে।কাছে আসতেই বুঝতে পারে ছেলে দুটো রাত ও ওর বন্ধু।
জাহিদ ও ইফরাত ক্যাম্পাসের মাঠ থেকে খেলা দেখে ফিরছিলো।পথিমধ্যে হঠাৎ পাপড়িকে আসতে দেখে।
পাপড়ি শামসুন্নাহার হলে থাকে।
প্রায়ই ভার্সিটি শেষে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে দেরি করে ফেরার পথে পাপড়ির সাথে দেখা হয় রাতের।পাপড়িকে তখন বড্ড ক্লান্ত দেখায়।দুর্বল হাসি হেসে রাতকে এড়িয়ে চলে যায় ।
জাহিদ পাপড়িকে জিজ্ঞেস করে,"কেমন আছেন আপি?"
ক্লান্ত স্বরে উত্তর করে,"যেমন দেখছো!"
তারপর রাতকে জিজ্ঞেস করে,"রাত এতো দেরি কেন?বাসায় যাবে কখন?কটা বাজে খেয়াল আছে?পড়া পড়বে কখন?এভাবে হলে তো ইন্জিনিয়ার হতে পারবে না,ইন্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের কেরানী হতে পারবে!"
জাহিদ শব্দ করে হেসে উঠে।কিন্তু রাত ভাবলেশহীন।ওর মনে চলছে অনেক কিছু।"আচ্ছা মেয়েটা এতো ক্লান্ত কেন?কোথায় যায় প্রতিদিন?ওর সাথে বেশ কিছুদিন যাবত কথা বললেও কেন যেন নিজের সম্পর্কে কিছু বলতে চায় না।জিজ্ঞেস করলেই এড়িয়ে যায়।"
পাপড়ি ধমকের স্বরে বলে,"এই ছেলে!"
"হ্যাঁ বলেন!"
"কি বলছি কথা কানে পৌঁছাচ্ছে না নাকি?"
রাত প্রশ্ন করে,"কোথায়....!"
রাতকে কিছু বলতে না দিয়ে পাপড়ি ওদের অতিক্রম করে চলে যায়।যেতে যেতে বলে যায় ,"দ্রুত বাসায় যাও...!"
রাত অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে।মাঝে মধ্যে মেয়েটাকে বুঝতে পারে না।মনে হয় এটা অপরিচিত কেউ যে পাপড়ির ভেতরে থাকে। সুপ্ত হয়ে ভেতরের কোথাও সেই অপরিচিতের বসবাস।সময়সাপেক্ষে বেড়িয়ে আসে আবার সুযোগ বুঝে লুকিয়ে পড়ে।
রাত ৯:৪৫।
রাত ফোন করে পাপড়িকে।দুইবার ফোন করলে ও ফোনটা বিজি পায়।ওর মনটা খারাপ হয়ে যায়।ভাবে হয়তো সোহানের সাথে কথা বলছে।ভাবতেই ভেতরে এক ধরনের হিংসা কাজ করছে।
ফোনটা রেখে খোলা জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে।চাঁদের আলোয় আলোকিত আকাশে মেঘেরা ভেসে যাচ্ছে দূর দুরান্তে,কোনো এক অজানার খোঁজে।
হঠাৎ ফোন বেজে ওঠে।স্ক্রিনে সুহাসিনী নাম ভেসে উঠেছে।দ্রুত ফোন কানে ঠেকায়।
ওপাশ থেকে রিনরিনে সুমিষ্ট কন্ঠের দুটো শব্দ শোনা যায়।রাত চোখ বুজে এতোক্ষণের মন খারাপ দূর করার চেষ্টা করে।
আবারো একি ভাবে শব্দ দুটো উচ্চারিত হয়,"কেমন আছো?"
"ভালো!আপনি?"
"ভালোই আছি!"
"এভাবে বলছেন যে!"
"এমনি।ডিনার হয়েছে? "
"জি।আপনি খেয়েছেন?"
"হ্যাঁ খেয়েছি।আজকের পড়া কমপ্লিট করেছো?"
"হ্যাঁ,পড়া শেষ করেই খেয়ে বিছানায় বসলাম।তারপরই আপনাকে..."
"কল দিলে...!"
"হ্যাঁ"
"কিন্তু বিজি পেলে।"
"হ্যাঁ!আচ্ছা! কার সাথে কথা বলেছেন জানতে পারি?"
"কেন রে পিচ্চি!"
"আমি পিচ্চি না"
"তো কি?বুড়ো? ড্রপ যাওয়া আবুল হোসেন?"
"জি না?আচ্ছা আপনার এজ কতো বলেন তো?"
"কেন বলবো?"
"বলেন বলছি,প্রতিদিন এই পিচ্চি পিচ্চি শুনতে আর ভালো লাগে না।"
"আচ্ছা যাও তোমাকে পিচ্চি ডাকবো না,আবুল হোসেন ভাই ডাকবো।"
"কখনই না...!এইজ বলেন।"
"মেয়েদের এইজ জানতে হয় না গাধা।"
"কেন?আজকে বলতেই হবে?আপনার বার্থ ইয়ার বলেন?"
"না বললে কি করবি পিচ্চি? "
"আবার!ঠিক আছে বলো না,আমার সমস্যা নেই।আমি এখন থেকে তোমাকে তুমি করে বলবো।"
"জীবনে ও না।আর এক বার ও বলবি না।"
"বলবো!তাহলে বলো এইজ কতো?"
"২৩"
"ওহহ আচ্ছা।আমার ২২+।মাত্র এক বছরের বড়ো।এটাকে সমবয়সীই বলে।আমার অনেক বন্ধু আছে যারা আমার চেয়ে বয়সে বড়ো।এডমিশন এক্সামের জন্য গেপ গেছে।আবার অনেকে আমার চেয়ে ছোটো।অথচ সেম ব্যাচে পড়ি।"
"হ্যাঁ বলছে তোরে!আমি তোর বড়ো!"
"বুঝলাম তো বড়ো,এটা বার বার বলার কি আছে।বড়ো তো কি হইছে,আপনাকে দেখে কি মনে হয় আমার বড়ো?মনে হয় ইন্টার লেভেলের স্টুডেন্ট!"
"এটা একটু বারাবাড়ি হয়ে গেলো না!"
"নাহহহ!একদমি না।ফার্স্ট যেদিন দেখলাম সেদিন ভাবছিলাম হয়তো অন্য কোনো ডিপার্টমেন্টের ফার্স্ট ইয়ারের স্টুডেন্ট হবেন।"
"আচ্ছা...! "
"হ্যাঁ !"
"ঘোড়ার ডিম।"
"কিন্তু ঘোড়া তো ডিম পারে না...!"
"পারে তোর মতো বলদ ঘোড়া পারে।"
"বলদ আবার ঘোড়া হয় কেম্নে?"
"ওফফ!রাতততত!মারবো কিন্তু!"
"ঠিক আছে মারো।কোথায় মারবে?গালে না পিঠে?".
" তোর কলিজাতে!ফোন রাখ! কোথা থেকে কোথায় গিয়েছে!তুই এতো পেঁচাছ কিভাবে রে?"
রাত মনে মনে বলে,"সেই কবেই তো কলিজাতে মেরে বসে আছেন।"কিন্তু মুখে বলে,"কি বলো...!কই পেঁচা... "
"চুপ....!"
"বাবা রে ভয় পাইছি!"
"গুড নাইট।"
"মিস ইউ।"
"গুড নাইট বললে এটা বলতে হয় !"
"হুম!"
"গাধা!"
ফোনের সংযোগ বিছিন্ন হয়ে যায়।রাত ফোনটা বিছানায় ফেলে সুখাচ্ছন্ন মন নিয়ে কোলবালিশটাকে জড়িয়ে ধরে চোখ বুজে এক সুন্দর অনাবিল স্বপ্নের আশায়।
__________________
জাহিদ ফার্স্ট ইয়ারের ইফতির সাথে রিলেশনে আছে।মাত্র কয়দিনে পুরো প্রেম কাহিনী বানিয়ে ফেলেছে।
আজকে বোটানিক্যাল গার্ডেনে দুজনে দেখা করতে যাবে।কলেজ শেষে রাত,কায়সার,জাহিদ যায় বোটানিক্যাল গার্ডেনে জাহিদকে সাপোর্ট দিতে ।
জায়গাটা একেবারে নিরব।কিন্তু চারিদিকে সবুজের সমারোহ।
রাতের ভালো লাগছে।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরই ইফতির আগমন হয়।সাথে ওর একটা বান্ধবী এসেছে।ইফতি ওদের সাথে কুশলাদি বিনিময়ের পর ওর বান্ধবী তুলির পরিচয় করিয়ে দেয়।
তারপর জাহিদ ও ইফতি গার্ডেনের ডান দিকে চলে যায়।
নিরবতার মধ্যে দিয়ে কেটে যায় দশ পনেরো মিনিট।তারপর নিরবতা ভেঙে প্রথম রাত বলে উঠে,"তুলি তুমি কোন বিভাগে?"
"অর্থনীতি বিভাগে।আপনি?"
"সিভিল। বাসা কোথায় তোমার?"
"যশোরে।"
"আচ্ছা,তাহলে তো হলে থেকে পড়তে হয়।"
"হ্যাঁ।"
"কোন হলে থাকো?"
"শামসুন্নাহার হলে।আপনি কোন হলে থাকেন?"
"আমি হলে থাকি না।আমার বাসা চট্টগ্রামেই।হালিশহর চেনো,সেখানের সেনানিবাসে থাকি।"
"ওহহহ আচ্ছা।ভালোই তো।আপনার বাবা কি ডিফেন্সে?"
"হ্যাঁ।যেহেতু সেম ব্যাচ আর ইফতির ফ্রেন্ড সেহেতু আমাদের ও ফ্রেন্ড মনে করতে পারো।"
"হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই।"
"তো আপনি করে বলছো কেনো?"
"আচ্ছা আর বলবো না।"
"আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞেস করি তোমাকে?"
"হ্যাঁ বলো।"
"থার্ড ইয়ারের পাপড়িকে চেনো?"
"কোন পাপড়ি!যোগাযোগ বিভাগের?"
"হ্যাঁ চেনো?"
"চিনবো না কেন!খুব ভালো করে চিনি।একি হলে থাকি তো।আপুরা উপরে থাকে আমরা নিচে।পাপড়ি আপুর জন্য আমি সিনিয়রদের র্যাগ থেকে বেঁচেছিলাম।আপু খুব ভাল,আর সবার থেকে আলাদা।ভার্সিটির সুন্দরী সিনিয়র আপু গুলো বড়ো ভাইদের জিএফ হওয়ার দরুন ভিষণ বদমাশ টাইপের হয়।কিন্তু এক মাত্র এই পাপড়ি আপুই অসাধারণ।বলো ভাবা যায় সম্পাদকের জিএফ হয়েও কারো ওপর নিজের কৃতিত্ব ফলায় না।নিজের মতো করে থাকে।"
"আচ্ছা ওর দেশের বাড়ি কোথায়?আই মিন জন্মস্থান কোথায়?"
"জানি না তো।তবে এটা জানি আপু এতিম।এছাড়া আর কেউ কিছু জানে না।ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর থেকে নাকি অনেক স্ট্রাগল করতে হয়েছে আপুকে।তাই তো সব জুনিয়রদের সাথে এতো সদয় উনি।ভুক্তভোগী কিনা!"
রাত বিস্মিত হয়ে যায়।বুকের ভিতরে কোথাও সূক্ষ্ণ ব্যথা হচ্ছে।
রাত প্রশ্ন করে,"তাহলে পড়াশোনা করে কিভাবে?খরচ চালায় কেমন করে?"
"সোহান ভাই আপুকে অনেক ফেসিলিটির ব্যবস্থা করে দিয়েছে।তারপর হোস্টেলে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে।উপবৃত্তির ব্যবস্থা করে দিয়েছে।তাই তেমন চাপ পড়ে না।আর আপু একদিন আমাকে বলেছিলো ক্যাম্পাসের বাইরে এই হাটহাজারীরই কয়েকটা স্টুডেন্ট পড়ায়।কিন্তু জানো ভার্সিটির অনেকের ধারণা টিউশন তো বাহানা মাত্র,আপু নাকি এমনি এমনি এই ভার্সিটিতে টিকে নেই।একজন লোক নাকি দামি গাড়ি চড়ে আপুর সাথে দেখা করতে আসে।আপুকে অনেক সমীহ করে, কিন্তু আপু ভিষণ এটিটিউট দেখায়।মানে সকলের ধারণা আপুর অনেকের সাথে অবৈধ মেলা...!
চলবে.......