ছবিঃ হৃদয়ের নিকুঞ্জ নিড়ে- গল্পকন্যা |
হৃদয়ের নিকুঞ্জ নিড়ে- পর্বঃ- ০৩ পড়ুন/link/button
এমন আদেশমূলক বাক্যে রাত,জাহিদ অবাক হয়ে মাথা তুলে চায়।আশ্চার্যানিত হয়ে অবুঝের মতো কয়েক সেকেন্ড চেয়েই থাকে।খানিকটা হতবিহ্বল,খানিকটা স্তম্ভিত হয়ে পড়ে।এ কাকে দেখছে!
মেয়েটি তার বাক্যের পুনরাবৃত্তি করে,"কি হলো সিগারেট ফেলো,বসবো তো!"
রাত সম্মোহনীর মতো হাতে থাকা সিগারেটের বাকি অংশ ফেলে দেয়।মেয়েটি পুনরায় ওদের থেকে কিছুটা দূরে পূর্বের স্থানে গিয়ে বসে পড়ে।
লাল পেড়ে সাদা শাড়ী পড়নে।হাতে,গলায় ও চুলের খোঁপায় শোভা পাচ্ছে রজনীগন্ধ্যা ফুল।রজনীগন্ধ্যা ফুলের মালার প্রতিটার মাথায় লাল গোলাপ,প্রতিটা পাপড়ির রঙ টকটকে রক্তাভ।একেবারে পাপড়ি গায়ের গোলাপী রঙের সাথে মিলে গেছে যেন।গাঢ় কাজল লেপ্টে আছে ডাগরডোগর আঁখি পল্লবে।লাল লিপস্টিকের প্রলেপে পাতলা ঠোঁট দুটোকে মনে হচ্ছে কোনো ফুটন্ত গোলাপের পাপড়ি।
দুই রমনীগণ একে অপরের সাথে কথা বলছে আর থেকে থেকে অহেতুক হাসিতে হেসে উঠছে।
কিন্তু এই মনোমুগ্ধকর কালবৈশাখি রূপে যে কারো কোমলপ্রাণে ঝড় বইছে সে খেয়াল কি আছে?
রাত শেন দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।
এদিকে জাহিদ ফার্স্ট ইয়ারের ইফতিকে ফাংশনে রেখে এখানে এসেছে,কেন যেন এ যাবৎ প্রেম করা সকল মেয়েদের থেকে এই মেয়েটিকে আলাদা মনে হয়েছে জাহিদের।ওর মনে হচ্ছে মেয়েটাকে সত্যিই মনে ধরেছে।কিন্তু এই রাতের জন্য তো ভালো করে কথাই বলতে পারলো না।
তারউপর একটা মাত্র সিগারেট ছিলো,সেটাও বড় আপুর জন্য হারাতে হলো।মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেছে।
জাহিদ রাতের দিকে তাকিয়ে দেখে মেয়ে দুটোর দিকে রাত পলকহীন চেয়ে আছে । নিজের চোখকে বিশ্বাস করাতে পারছে না।"এ কি দেখছে!সত্যি নাকি চোখের ভুল!"
রাতের উদ্দেশ্যে বলে,"কি রে..!"
"হুঁ..!"
"কি দেখতেছিস?"
"অসম্ভব সুন্দর...! "
"হুম ঝর্ণাটা সুন্দর,কিন্তু অনেকবার দেখা হয়েছে।"
"পাহাড়ির ঝর্ণার চেয়ে সুন্দর ঐ ঝর্ণার পাশের শুভ্রপরী, সুহাসিনী!"
"ভাই আমার ক্রাশ টাশ খাইছ না,দোনোটাই মিঙ্গেল!"
"কবেই তো খেয়ে বসে আছি!"
জাহিদ অবাক হয়ে শুনে যাচ্ছে রাতের উদ্ভটতম কথা বার্তা।হঠাৎ পাপড়ি নামক মেয়েটি ঘাড় ফিরিয়ে তাকায়।চোখ পড়ে রাতের দিকে।রাতের এমন ঘোর লাগা চাহুনিতে অস্বস্তি বোধ করে।ভ্রু নাচিয়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করে,"কি?"
রাতের স্তম্বিত ফিরে,দু পাশে মাথা দুলিয়ে বোঝায় কিছু না।
এমন বোকামতে নিজেকে নিজে শাসানি দেয়।বোঝায় অন্য কারো জিএফএর দিকে এভাবে তাকাস না ভাই।কিন্তু অবাধ্য মন শোনে না বারণ।আবারো দেখে যায়।
মেয়েটিও পুনরায় তাকায়।চোখে চোখ পড়তেই দৃষ্টি লুকানোর বৃথা চেষ্টা করে।তখুনি রাতকে ভয় পাইয়ে দিয়ে মেয়েটি ডেকে উঠে,"এই যে ধবলু ভাইয়া! এ দিকে আসো!"
রাত জাহিদ দুজনে চমকে যায়।জাহিদ রাতকে বিরবির করে কিছু বলে,কিন্তু বুকের ভিতর থাকা হার্ট নামক যন্ত্রটা এমনভাবে ট্রাম বাজানো শুরু করেছে,যে জাহিদের শব্দ গুলো তার কর্নকুহরে পৌঁছাচ্ছেই না।
জাহিদ বলে,"আপি আমি?"
"জি না পাশের ধবলু,আসো তুমি!"
রাত বলে,"আমি...?"
"আরে বাবা হ্যাঁ,আসো।"
রাত বুকের ধুকপুকানি নিয়ে উঠে পড়ে।এক ধরনের ভয় ওর সমস্ত তনুকায় আচ্ছন্ন করে রেখেছে।কাছে আসতেই মেয়েটি বলে,"কোন ইয়ার?"
রাতের মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে পরীক্ষায় নকল করতে গিয়ে কোনো মেজিস্টিসের সামনে ধরা পড়েছে।ভরকানো অবস্থায় বলে,"ফার্স্টইয়ার।"
ভ্রু কুঁচকে বলে,"দেখেতো মনে হয় ফাইনাল ইয়ারের ড্রপ যাওয়া আবুল হোসেন,তা কোন ডিপার্টমেন্ট?"
রাত এবার নিজের বডি গ্রোথনেসের জন্য লজ্জিত বোধ করছে।"ও একটু গলুমলু,তাই বলে কি ওকে ফাইনাল ইয়ারের ড্রপ যাওয়া দাড়ি-গোঁফ আলা বুড়োদের মতো লাগে নাকি?"
মেয়েটি ভ্রু নাচিয়ে ইশারা করে প্রশ্নের উত্তর জানতে চায়।
"সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্ট।"
মেয়েটি বলে,"সিট ডাউন।"
রাত সম্মোহনীর মতো কিছুটা দূরত্বে বসে পড়ে।বসার পর মেয়েটি রাতের দিকে তাকিয়ে বলে,"চেনো আমাকে?"
"জি না"
"আমার সম্পর্কে কিছু জানো?"
দুপাশে মাথা নাড়িয়ে বলে,"না!"
"তো এভাবে তাকিয়ে ছিলে কেন?"
মাথা নিচু করে বলে,"সরি"
"আশ্চর্য্য! সরি কেন?"
"তাকানোর জন্য! "
"আমি বলেছি তোমাকে সরি বলতে?"
রাত আশ্চর্য্য হয়ে তাকিয়ে ভাবে,"বলে কি মেয়েটা!তাহলে করবোটা কি?"রাত ভাবে,"হুমায়ুন আহমেদ স্যার ঠিকি বলেছেন,মেয়েরা কি চায় আসলে তারা নিজেরাই জানে না!"
"ইউ নো দ্যাট, আ'ম ইউর সিনিয়র।" খানিক থেমে ফের বলে,"আমার নাম রোদেলা হোসাইন পাপড়ি।যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ,তৃতীয় বর্ষ।"
এবার রাতকে অবাক করে দিয়ে বলে,"আর ইউ ক্রাশড?"
রাতের মুখ হা হয়ে যায় এমন স্ট্রেটফোরওয়ার্ড কথায়।মুখে কোনো কথা ফুটছে না, উত্তর দিবে কি।
রাতকে অবাকের শেষ প্রান্তে নিয়ে বলে, "যারা আমার উপর ক্রাশ খায়,আমার প্রেমে পড়ে,তাদের আমি আমার ভাই বানিয়ে নেই।"
"এবার বলো ,তুমি কি...হতে চাও?"
রাত এমন সাংঘাতিক কথা শুনে হুরমুর করে উঠে দাঁড়ায় বলে,"নাথিং! "বড়ো বড়ো পা ফেলে,জায়গাটা ত্যাগ করার জন্য।পেছন থেকে মেয়ে দুটো জোড়ে জোড়ে হাসতে থাকে।
জাহিদ তখন থেকেই ভম্বলের মতো করে দাঁড়িয়ে বোঝার চেষ্টায় ছিলো,এখন রাতের এই অবস্থা দেখে ভিষণ হাসি পাচ্ছে।কিন্তু মেয়েদের সামনে হেঁসে বন্ধুকে ছোটো করা যাবে না।আড়ালের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
সেদিন সারাদিন এমন কি বাসায় ফেরার পরও কিছুতেই মেয়েটার ভূত মাথা থেকে নামছিলো না।
পরেরদিন ভার্সিটিতে পৌঁছে কোনো এক অদৃশ্য অমোঘ টানে সামাজিক বিজ্ঞান ফ্যাকাল্টির অঙ্গনে দাঁড়িয়ে থাকে রাত ।যা প্রবেশকালে চোখ এড়ায়নি পাপড়ির।
এভাবে একদিন, দুদিন,পর পর আট দশ দিন,এক মাস,চলতেই থাকে।পাপড়ির নজরেও প্রতিদিন বিষয়টা পড়তে থাকে।
ততদিনে বন্ধুদের সকলে রাতের দুর্বলতা বুঝতে পেরে গেছে।সম্পাদকএর জিএফ না হলে সবাই সাপোর্ট করতো।কিন্তু এখন সরে আসার জন্য বোঝাচ্ছে,অনুরোধ জানাচ্ছে সবাই।
রাত নিজেও বুঝতে পারে এভাবে চলতে থাকলে বিপদজনক পরিস্থিতির উদ্ভব হবে।আর হয়তো তা অতি সন্নিকটেও।কিন্তু নিজেকে হাজার বার বারণের পরেও,বোঝানোর পরেও সরে আসতে পারছে না। চাইলেও ভুলে যেতে পারছে না মেয়েটিকে।ওর নিজের অজান্তেই মুগ্ধতা ছেড়ে কখন যে তা কঠিন ভালোবাসায় রুপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে,নিজেই জানে না।
__________________
মেঘাচ্ছন্ন আকাশ।
সকাল থেকে ভালোই ছিলো।কিন্তু বারটার দিকে আকাশে ধীরে ধীরে মেঘ জমতে শুরু করে।কিছু ক্ষণের মধ্যেই ঘন মেঘে আকাশ অন্ধকারে ছেয়ে গেছে।যে কোনো সময় বৃষ্টি হবে বলে মনে হচ্ছে।গাছপালা গুলো কোনো মহা উৎসবের আগাম বার্তা পেয়ে প্রবল ভাবে বইতে শুরু করছে।
ক্লাসে বসে বাইরের মনভোলানো প্রাকৃতিক রূপ দেখে রাতের মনোযোগ বিচ্ছিন্ন হয়।মনটা অশান্ত হয়ে উঠে।
ত্রিশ মিনিটের অবসানের পর ক্লাস শেষ করে বাইরে বেরোয়।সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ছুটে চলে রাস্তা ধরে ওর প্রশান্তির খোঁজে।
চারিদিকে ঠান্ডা শিতল বাতাস, মন প্রাণকে একেবারে শীতল করে দিচ্ছে।
সামাজিক বিজ্ঞান ফ্যাকাল্টির সামনে আসতেই ঝরঝর করে বৃষ্টি নামতে শুরু করেছে।আর এই বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজতে থাকে রাত।প্রায় পৌঁনে এক ঘন্টা পর পাপড়ি বেরিয়ে আসে।চারদিক শুনশান নিরব,ঝুম বৃষ্টির ছন্দ ছাড়া কোনো শব্দ শোনা যাচ্ছে না।পাপড়ি ছাতা মাথায় বেরিয়ে আসে ভবন থেকে রাস্তায়।এগিয়ে আসতে আসতে একেবারে রাতের সামনে এসে দাঁড়ায়।রাত অপলক দৃষ্টিকে চেয়ে থাকে বৃষ্টিতে ছাতা মাথায় আগত বৃষ্টি ভেজা পাপড়ির দিকে।
এখনো এ ভবনের কারো ক্লাস শেষ হয়নি।তাই তেমন কেউ বের হয়নি।যাই দুই একজন দাঁড়িয়ে আছে,তারাও বৃষ্টির জন্য আটকা পড়ে গেছে।
পাপড়ি রাতের সামনে এসে ছাতাটা খানিক উপরের দিকে তুলে দাঁড়ায়।তারপর কয়েক সেকেন্ড আশ্চর্য্য হয়ে তাকিয়েই থাকে।তারপর রাতের উদ্দেশ্য বলে,"ভালোবাসো?"
রাত কিছু বলে না,চুপচাপ শান্ত বাঁচ্চার মতো মাথা নিচু করে রাখে।তাই দেখে পাপড়ি বলে,"কতোটা ভালোবাসো?"
রাত এবারো কোনো উত্তর দেয় না।মনে ভয় কাজ করছে,পাছে যদি ভাই বানিয়ে দেয়।নয়তো ডিরেক্ট বলার সাহস রাখে রাত।
নত মস্তকেই বলে উঠে,"বলতে পারবো না!আপনি আমাকে ভাই বানিয়ে ফেলবেন!"
সহজ সরল বাচ্চা সুলভ ডিরেক্ট কথায়,পাপড়ি মুখে হাত চেপে হো হো করে হেঁসে উঠে।তারপর ব্যাগ থেকে কাগজ কলম নিয়ে কিছু লিখে রাতের হাতে গুঁজে দিয়ে বলে,"আর এভাবে রোদ বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে থাকবে না।শরীর খারাপ হবে,পড়াশোনায় ক্ষতি হবে।"
কাগজের দিকে তাকিয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে রাতের পা কাঁপছে।চোখ মুখে উপচে পড়ছে অবাধ্য খুশিরা।রাত মাথা নাড়ালো।যার অর্থ ঠিক আছে।
পাপড়ি পা বাড়ায় যাওয়ার জন্য।পেছন থেকে রাত "ইয়েস" বলে লাফিয়ে উঠে।
মেয়েটি পিছু ফিরে রাতকে দেখে বলে......