আমাদের সাথে সোস্যাল মিডিয়ায় যুক্ত থাকতে আমাদের ফেইসবুক পেইজে লাইক দিন Facebook Follow us!

একটি লাল লঙ্কা- সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় (কাকাবাবু সমগ্র) পর্ব-০২

কাকাবাবু সিরিজ,সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়,গোয়েন্দা গল্প,
Estimated read time: 10 min
ছবিঃ একটি লাল লঙ্কা- সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

একটি লাল লঙ্কা- পর্বঃ- ০১ পড়ুন/link/button

সদ্য বরফ গলতে শুরু করেছে বলে পাথর এখানে সাঙ্ঘাতিক পিছল। কাকাবাবু প্রতিবার ক্রাচ তুলছেন আর ফেলছেন দারুণ সাবধানে। তবু এক-একবার হড়কে যাচ্ছে।

অরিজিৎ করুণ মুখ করে বলল, কাকাবাবু, আপনাকে আর যেতে হবে না। এরপর ওপরটায় গিয়ে আমিই খুঁজে দেখছি।
কাকাবাবু কোনও উত্তর না দিয়ে মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকালেন। এখন ঘড়ি অনুযায়ী দুপুর সাড়ে তিনটে, কিন্তু এর মধ্যেই যেন সন্ধে হয়ে এসেছে। আকাশের এক দিকটা লাল।

এই ঠাণ্ডাতেও কাকাবাবুর কপালে বিন্দু-বিন্দু ঘাম জমেছে। তাঁর নিশ্বাসের কষ্ট হচ্ছে। কাঠমাণ্ডুতে তাকে দু-তিনজন বার-বার অক্সিজেন সঙ্গে নেবার কথা বলেছিল, কাকাবাবু তাতে কৰ্ণপাত করেননি। তিনি ভেবেছিলেন, আজকাল তো অক্সিজেন ছাড়াই কেউ-কেউ এভারেস্টেও ওঠার চেষ্টা করছে, সুতরাং এই বারো-তেরো হাজার ফিট কী আর কষ্ট হবে! কাকাবাবু নিজেও এর চেয়ে উঁচুতে উঠেছেন আগে, কিন্তু এবারে তাঁর হািফ ধরে যাচ্ছে। হঠাৎ যেন বাতাস কমে গেছে। এদিকে।

অরিজিৎ আবার বলল, কাকাবাবু, আপনি এখানে বসেই বিশ্রাম নিন। বরং। আমি ওপর দিকটা দেখে আসছি। আগেরবার এখানেই পেয়েছিলুম।

কাকাবাবু জোর দিয়ে বললেন, না, আমি শেষ পর্যন্ত দেখতে চাই! তুমি আমাকে এত দূর নিয়ে এসেছ, এইটুকু আর বাকি থাকে কেন?

অরিজিৎ বললেন, আপনি বিশ্বাস করুন, আমি আগেরবার এই জায়গাতেই পেয়েছি। ওই ফল।

কাকাবাবু বললেন, এখন আমি তোমার সব কথাই বিশ্বাস করতে বাধ্য।

চতুর্দিকে সাদা বরফের টোপর-পরা পাহাড়ের চুড়া। মাঝে-মাঝে ঘাসের চাপড়া ছাড়া বড় গাছ আর এদিকে নেই। এদিককার শেষ গ্ৰাম নাংপো থেকে ওরা বেরিয়েছে। সকাল ছাঁটায়। সারা দিনে একবারও সূর্যের মুখ দেখা যায়নি।

এই নিয়ে তিন দিন কেটে গেল এই অঞ্চলে। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও কোথাও দেখা যায়নি। সেই লাল লঙ্কার মতন ফলের গাছ।

দুজন মাত্র শেরপাকে সঙ্গে আনা হয়েছে। আং শেরিং আর ছোটা দাজু। কাকাবাবু তাঁর পুরনো বন্ধু মিংমাকে খোঁজ করেও পাননি, সে চলে গেছে। অন্য কোনও অভিযাত্রীদের সঙ্গে।

আং শেরিং আর ছোটা দাজু দারুণ তেজী আর শক্তিশালী, কিন্তু তারা এই কাস্তের মতন পাহাড়টায় কিছুতেই উঠতে চায় না। তাদের ধারণা, এই পাহাড়টায় অপদেবতা আছে! খানিকটা নীচে তারা থেমে গেছে!

শোঁশোঁ করে হাওয়া বইতে শুরু করে দিল। অরিজিৎ আরও কাচুমাচুভাবে বলল, কাকাবাবু, আজকে আর থাক, আবার কাল চেষ্টা করা যাবে।

কাকাবাবু বললেন, এতখানি উঠেছি। যখন, এ-পাহাড়টা আজ দেখা শেষ করতেই হবে! চলো, আর দেরি করে লাভ কী?

অন্ধকার হয়ে গেলে আর কিছু দেখা যাবে না!

আমার কাছে টর্চ আছে। তুমি জানো না অরিজিৎ, সন্তুকে সঙ্গে না নিয়ে আমি আজকাল কোথাও যাই না! এবার সন্তুর জন্যই আমাকে এখানে আসতে হয়েছে?

কাকাবাবু, সন্তু যে এরকম একটা কাণ্ড করবে, আমি ভাবতেই পারিনি।

আলমারিটায় তালা না দিয়ে আমি ভুল করেছি। আসলে আমি তোমার কথায় বিশ্বাস করিনি, গুরুত্বও দিইনি! এখনও আমার বিশ্বাস হচ্ছে না!

সেই রাতের পর থেকে সন্তুকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। ছাদের ওপর পড়ে ছিল কৌটোটা, তার মধ্যে লাল লঙ্কার মতন ফলটাও নেই। অরিজিৎ তো দেখেই মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছিল। তার ধারণা, সন্তু সেই ফলটা খেয়ে ফেলে অদৃশ্য হয়ে গেছে!

কাকাবাবু সন্তুর ঘর এবং ছাদের প্রায় প্রতিটি ইঞ্চি পরীক্ষা করে দেখেছেন। সন্তুর হঠাৎ চলে যাওয়ার কোনও চিহ্নই নেই। সে পাজামা আর পাঞ্জাবি পরে ছিল, তার চাটি-জোড়া পর্যন্ত রয়ে গেছে, বিছানার ওপর একটা বই আধ-খোলা। সন্তু কোনও কারণে হঠাৎ কোথাও চলে গেলে নিশ্চয়ই কাকাবাবুকে চিঠি লিখে রেখে যেত কিংবা কিছু একটা চিহ্ন রেখে যেত। সেরকম কিছুই নেই।

তবে, সন্তু যে এই লাল ফলটা চুপিচুপি খেয়েছে, তাও তো ঠিক। সে সত্যিই অদৃশ্য হয়ে গেল?

অরিজিৎ এখন বলছে যে, অদৃশ্য মানুষদের নাকি কথা বলারও ক্ষমতা থাকে না। কিংবা তাদের কথা কেউ শুনতে পায় না। সে নিজে যোবার অদৃশ্য হয়েছিল, সেবার গ্রামের মানুষদের কাঁধে হাত দিয়ে ডেকেছিল, তাও তারা বুঝতে পারেনি কিছুই। অদৃশ্য মানুষের ছোঁয়াও টের পাওয়া যায় না।

এইসব কথা শুনেই রাগে কাকাবাবুর গা জ্বলে গেছে!

দুদিন অপেক্ষা করেও সন্তুর কোনও খোঁজ না পেয়ে কাকাবাবু উতলা হয়ে উঠেছিলেন। তা হলে কি অরিজিতের কথাই ঠিক? সন্তু একেবারে হাওয়ায় অদৃশ্য হয়ে গেল! তখন তিনি জেদ ধরলেন, তিনি নিজে ওই ফল একটা খেয়ে দেখবেন! সন্তু একটা ফল খেয়ে অদৃশ্য হয়ে গেছে, এরকম একটা অদ্ভুত কথা তিনি তাঁর বৈজ্ঞানিক-বন্ধুদের কিংবা পুলিশ-বন্ধুদেরও বলতে পারেনি! তাঁরা নিশ্চয়ই ভাবতেন, কাকাবাবুর মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে!

পরের দিনই টিকিট কেটে কাঠমাণ্ডু। তারপর গাড়িতে অনেকটা পথ আসার পর শুরু হয়েছে পায়ে হাঁটা।

আং শেরিং আর ছোটা দাজুকে প্রথমে আসল উদ্দেশ্যটা বলা হয়নি। কাকাবাবু বলেছিলেন তিনি সিলভার লেপার্ডদের ছবি তুলতে চান। পৃথিবীতে শুধু এই অঞ্চলটাতেই রুপোলি নেকড়েদের কদাচিৎ দেখা পাওয়া যায়। কাঠমাণ্ডুতেও তিনি এই কথা বলেই অভিযানের অনুমতি জোগাড় করে এনেছিলেন।

এই কাস্তের মতন পাহাড়টার কাছে এসে আং শেরিং বলেছিল, সাহেব, এখানে তো সিলভার লেপার্ড পাবেন না! এখানে অপদেবতারা আসে, এখানে অন্য কোনও জন্তু-জানোয়ার থাকে না। সিলভার লেপার্ড খুঁজতে গেলে আরও হাজার ফিট উঁচুতে উঠতে হবে।

তখন কাকাবাবু অন্য কিছু বলতে বাধ্য হলেন। তিনি সরাসরি ইয়েতির প্রসঙ্গ না তুলে বলেছিলেন, আমি একটা লাল লঙ্কার মতন ফল খুঁজছি, যা অনেক ওষুধ হিসেবে কাজে লাগে।

সেই কথা শুনেই আং শেরিং আর ছোেটা দাজু একসঙ্গে ভয় পেয়ে বলে উঠেছিল, বিষফল! বিষফল!

কাকাবাবু অনেক কষ্টে তাদের কাছ থেকে আরও খবর জেনেছিলেন। ছোেটা দাজুর বয়েস কম, সে কখনও ওই ফল দ্যাখেইনি। পাহাড়ে ওই ফল খুব কমই দেখা যায়। আং শেরিং বলেছিল, সে ওই ফল দুবার মাত্র দেখেছে। তেরো হাজার ফিটের কাছাকাছি উচ্চতায় ওই ফলের গাছ জন্মায় পাহাড়ের খাঁজে-খাঁজে। সেই ফল প্ৰথমে থাকে কালো, তারপর লাল হবার আগেই কারা যেন তুলে নেয়। ওরকম লাল ফল খুব কমই দেখা যায়। সকলেরই ধারণা, ওই লাল লঙ্কার মতন ফলগুলো অপদেবতাদের খুব প্রিয় খাদ্য।

আং শেরিং আরও একটা রোমহর্ষক কাহিনী শুনিয়েছিল। তাদের গ্রামের দুটি ছেলে একবার এই কাস্তে-পাহাড়ের (এরা বলে সরু চাঁদের পাহাড়) ওপরে গিয়ে ওইরকম দুটো বেশ লাল ফল দেখে খেয়ে ফেলেছিল। তারপর তাদের চেহারা, বদলাতে শুরু করে, তাদের সারা গায়ে বড়-বড় রোম গজিয়ে ওঠে, চেহারাটা হয়ে যায় বাঁদরের মতন, তারা লাফাতে-লাফাতে গ্রাম ছেড়ে পাহাড়ের দিকে চলে যায়। আর ফিরে আসেনি। সেই থেকে ওরা সবাই ওইরকম লাল ফল কখনও দেখতে পেলেও হাত দিতে সাহস করে না।

এই ঘটনা শুনে অরিজিৎ গোল-গোল চোখে কাকাবাবুর দিকে তাকিয়ে ছিল। তবু কাকাবাবুর বিশ্বাস হয়নি। ওই ফল নিজে খেয়ে দেখার ইচ্ছে তাঁর মনে আরও জোরালো হয়েছিল।

আং শেরিংরা আর আসতে চায়নি, তবু কাকাবাবু চুড়া পর্যন্ত উঠে দেখতে চান।

আকাশের রং ক্রমে স্নান হয়ে আসছে, এরপর নীচে নামতে আরও বেশি। অসুবিধে হবে। তবু কাকাবাবু আস্তে-আস্তে ক্ৰাচ ফেলে ওপরে উঠছেন।

একটু পরে অরিজিৎ বলল, কাকাবাবু, আমায় ক্ষমা করুন। আমার ভুল হয়েছে! ওই যে পাশের পাহাড়টা দেখুন। এখান থেকে ওটাকেও ঠিক কাস্তের মতন মনে হচ্ছে। পাশাপাশি দুটো ঠিক একই রকমের পাহাড়। আমার মনে হচ্ছে, আমি ওই পাশের পাহাড়টাতেই ফলগুলো পেয়েছিলুম।

কাকাবাবু থেমে কয়েকবার জোরে-জোরে নিশ্বাস নিলেন। তারপর বললেন, তোমার আর কিছু ভুল হয়নি তো? তুমি ওই লাল ফল নিজে কি সত্যি খেয়েছিলে?

অরিজিৎ বলল, নিশ্চয়ই। আপনার কাছে কি আমি মিথ্যে কথা বলব? তা ছাড়া এরকম একটা অদ্ভূত অভিজ্ঞতা না হলে আপনার কাছে আমি এত দূর থেকে ছুটে যাবই বা কেন।

কাকাবাবুর এক দিকের কাঁধে ঝুলছে ক্যামেরা, অন্য দিকে কাঁধে রাইফেল। তিনি দুটোই নামিয়ে রাখলেন। তারপর ওভারকেটের পকেট থেকে একটা ছোট্ট ফ্লাস্ক বার করে এক ঢোঁক গরম চা খেলেন।

হঠাৎ ডান দিকে ঘুরে একটা ক্রােচ তুলে তিনি বললেন, ওটা কী দ্যাখো তো তশরিজিৎ?

একটা অতিকায় কচ্ছপের মতন দেখতে পাথরের খাঁজে টমাটো গাছের মতন একটা গাছ উঁকি মারছে। তাতে ফলে আছে ক্যাপসিকামের মতন একটা লাল লঙ্কা!

সেদিকে তাকিয়ে অরিজিতের চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল। সে কোনওক্রমে বলল, এই তো, এই তো!

কাকাবাবু বললেন, তোমার কথায় এইটুকু বিশ্বাস করা গেল যে, এত উঁচু পাহাড়েও ওইরকম লঙ্কার মতন ফল দেখা যায়। বেশ ভাল কথা। এবার ওটাকে ছিড়ে আনো। আমি খেয়ে দেখব!

অরিজিৎ আর্তকণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল, না, না! কাকাবাবু, আপনি খাবেন না। সন্তুর জন্য নিয়ে চলুন!

কাকাবাবু আর কিছু বলার আগেই একটু দূরে খুব জোরে একটা হা-হা-হা শব্দ হল। কোনও জন্তু যেন খুব যন্ত্রণায় কাঁদছে!

কাকাবাবু ফ্লাস্কটা পকেটে ঢুকিয়ে রাইফেলটা তুলে নিলেন।

অরিজিৎ বলল, কাকাবাবু, চলুন, পালাই! কে যেন আসছে!

কাকাবাবু গম্ভীর গলায় বললেন, ওই ফলটা না নিয়ে আমি যাব না। যে আসে আসুক?

অরিজিৎ কাকাবাবুর হাত ধরে টানতে যেতেই কাকাবাবু এক ঝটিকায় তাকে সরিয়ে দিলেন। তারপর লাল ফলটা ছিড়ে নেবার জন্য একটু এগোতেই দেখলেন, মাত্র আট-দশ ফিট দূরে একটা প্রাণীর মুখ। সেটা ভালুক কিংবা শিম্পাজির হতে পারে, কোনও ক্রমেই মানুষের নয়।

কাকাবাবুর প্রথম মনে হল, ক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলার। কিন্তু রাইফেল নামিয়ে রেখে ক্যামেরাটা তুলে নিতে দেরি হয়ে যাবে। জন্তুটার চোখ দুটো অসম্ভব হিংস্ৰ, সে এক পা, এক পা করে এগিয়ে আসছে।

কাকাবাবু ছবি তোলার বদলে রাইফেল উচিয়ে জন্তুটাকে গুলি করতে গেলেন!

সঙ্গে সঙ্গে অরিজিৎ কাকাবাবুর ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে বলল, কাকাবাবু, গুলি করবেন না। ও আমাদের সন্তু! ও সন্তু!

লোড-করা রাইফেলে ঝাঁকুনি লেগে গুলি বেরিয়ে গেল। তার শব্দ ছড়িয়ে পড়ল এক দিগন্ত থেকে অন্য দিগন্তে। সেই লোমশ প্রাণীটা ভয় পাবার বদলে আরও সামনে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল ওদের দুজনের ওপর!

অরিজিতের কথা শুনেই কাকাবাবু দ্বিতীয়বার গুলি করতে পারলেন না…। তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন, সন্তু? তুই কি সন্তু?

লোমশ প্রাণীটা কাকাবাবুকে এক ধাক্কা মােরল। অরিজিৎকে শূন্যে তুলে ষ্টুড়ে দিল নীচের দিকে। সে গড়িয়ে পড়ে যেতে লাগল।

জন্তুটার ধাক্কায় কাকাবাবুও গড়িয়ে গেলেন খানিকটা। কিন্তু এক জায়গায় থেমে যাবার পর বুঝলেন, তাঁর নিজের হাত-পা ভাঙেনি। কিন্তু অরিজিৎ তখনও গড়াচ্ছে।

তিনি চিৎকার করে বললেন, আং শেরিং, ছোটা দাজু, ওকে ধরো!

খানিকবাদে ছোটা দাজুর সাহায্য নিয়ে কাকাবাবু নীচে নেমে এলেন। আং শেরিং অরিজিৎকে কোলে নিয়ে বসে আছে। অরিজিতের জ্ঞান নেই, তার মাথা কেটে গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে, খুব সম্ভবত একটা হাতের হাড়ও ভেঙে গেছে। জামা-টামা রক্তে মাখামাখি!

আং শেরিং শান্ত গলায় কাকাবাবুকে বলল, সাহেব, তোমাদের বলেছিলুম না, ওই অপদেবতার পাহাড়ে উঠে না! এক্ষুনি শহরের হাসপাতালে নিয়ে না। গেলে এই সাহেবটা বাঁচবে না!

পরের দিনই কাকাবাবু অরিজিৎকে নিয়ে পৌঁছে গেলেন কাঠমাণ্ডুতে। কাকাবাবুর নিজেরও যে একটা হাত মচকে গেছে আর ডান দিকের কানের পেছনে অনেকটা জায়গা থেতলে গেছে, সে-কথা কাউকে বললেন না। অরিজিৎকে সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করে তিনি সেখানেই বসে রইলেন। সারা রাত। ভোরবেলা অরিজিতের জ্ঞান ফিরেছে, আর তেমন বিপদের আশঙ্কা নেই শুনে কাকাবাবু ফিরে গেলেন হোটেলে।

সারা রাত জাগলেও সকালবেলা ঘুমোবার কোনও মনে হয় না। কাকাবাবু ভাল করে স্নান করে ব্রেকফাস্টের অর্ডার দিলেন। তাঁর চোয়াল শক্ত হয়ে আছে। তিনি কোনওদিন হার স্বীকার করেন না। তিনি মনে মনে ঠিকই করে ফেলেছেন এর মধ্যে যে, আবার তিনি ওই কাস্তে-পাহাড়ে ফিরে যাবেন। ওই লাল লঙ্কার মতন একটা ফল তাঁর চাই-ই চাই! ওই ফল খাওয়ার পরের ফলাফল তিনি নিজে না বুঝলে সন্তুকে কিছুতেই খুঁজে বার করা যাবে না!

সবে মাত্র ব্রেকফার্স্ট শেষ করেছেন, এমন সময় বেজে উঠল টেলিফোন। হাসপাতাল থেকে কোনও খবর এসেছে ভেবে তিনি রিসিভারটা তুলেতেই অন্য দিকের গলার আওয়াজ শুনে আনন্দে তাঁর বুকটা কেঁপে উঠল। সন্তু?

সন্তু বলল, উফ, কাকাবাবু, এতক্ষণে তোমাকে পাওয়া গেল। আমি কাল দুপুর থেকে কাঠমাণ্ডুর সব হোটেলে তোমাকে খুঁজছি!

কাকাবাবু উত্তেজনা দমন করে জিজ্ঞেস করলেন, সন্তু, তুই কোথা থেকে কথা বলছিস?

সন্তু বলল, কলকাতা থেকে। আমাদের বাড়ি থেকে।

আমাদের বাড়ি থেকে! তুই তা হলে অদৃশ্য হয়ে যাসনি?

হা-হা-হা, কী যে বলো! তুমিই না বলেছিলে, মানুষের পক্ষে অদৃশ্য হওয়া অসম্ভব।

তা তো বটেই! কিন্তু তোকে আমরা খুঁজে পাইনি কেন? তুই কোথায় গিয়েছিলি? তুই লাল লঙ্কাটা খেয়েছিলি না?

হ্যাঁ, কাকাবাবু, আমি ভেবেছিলুম, আমি নিজে পরীক্ষা করে দেখব। কিন্তু, ওটা স্ট্রবেরিও নয়, লঙ্কাও নয়, ওটা একটা বিষাক্ত ফল। ওটা খেলে মাথা ঘুরে যায়, কান ভৌভোঁ করে, তারপর মানুষ অজ্ঞান হয়ে যায়। অদৃশ্য-টাদৃশ্য কিছু হয় না?

তা হলে তুই কোথায় ছিলি, সন্তু?

সেটা একটা মজার ব্যাপার! তোমার সেই ত্রিপুরার রাজকুমারের কথা মনে আছে? আমাদের ওপর তার খুব রােগ! সে দুটো গুণ্ডা পাঠিয়েছিল আমাকে ধরে নিয়ে যাবার জন্য। গুণ্ডা দুটো ড্রেন পাইপ বেয়ে উঠে এসেছিল ছাদে। তারা ভেবেছিল, আমাকে জোর করে, হাত-পা বেঁধে নিয়ে যাবে। কিন্তু তারা ধরবার আগেই আমি অজ্ঞান। ওরাই ঘাবড়ে গেল!

কাকাবাবু একটুখানি চুপ করে গিয়ে শান্ত গলায় বললেন, তোর ভয় পাবার দরকার নেই, সন্তু। আসল ব্যাপার কী হয়েছিল বল তো?

সন্তু বলল, আমি আসল কথাটাই বলছি তো! রাজকুমার আমাকে বেঁধে নেবার জন্য দুটো লোক পাঠিয়েছিল। ঠিক সেই সময়ে আমি অজ্ঞান, কোনও বাধাই দিতে পারিনি। লাল লঙ্কটা তক্ষুনি খেয়ে ছিলুম যে! তারপর নাকি আমি পাক্কা আড়াই দিন অজ্ঞান হয়ে থেকেছিলুম। গোড়ার দিকটা আমার মনে নেই। কিন্তু শেষের দিকে আমি আধো-আধো স্বপ্নে কত দেশে ঘুরে বেড়িয়েছি! অন্যদের কথা একটু-একটু শুনতে পেলেও উত্তর দিতে পারিনি! বুঝলে কাকাবাবু, এই লাল লঙ্কার রহস্যটা আমি আবিষ্কার করেছি। ওটা একটা বুনো বিষাক্ত ফল, ওটা খেলে মানুষ অনেকক্ষণ অজ্ঞান হয়ে থাকে। সেই সময় স্বপ্ন দেখে ভাবে, বুঝি অদৃশ্য হয়ে অনেক জায়গায় ঘুরছে। আমি ডেফিনিট, অরিজিৎদার এইরকম ব্যাপারই হয়েছে!

কাকাবাবু অবিশ্বাসের সুরে বললেন, সেই রাজকুমার লোক পাঠিয়ে তোকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল? সেখান থেকে তুই ছাড়া পেলি কী করে!

সন্তু হাসতে হাসতে বলল, রাজকুমার খুব জব্দ হয়ে গেছে, কাকাবাবু! ওর লোক তো অজ্ঞান অবস্থায় আমাকে ধরে নিয়ে যায়। আড়াই দিনের মধ্যে আমি জাগিনি, মাঝখানে কী ঘটেছে তা-ও আমি জানি না! এদিকে রাজকুমার ভেবেছিল, ওর শাগরেদদের হাতে মার খেয়ে আমি বুঝি মরতে বসেছি। ডাক্তার ডেকে এনে আমার চিকিৎসা করিয়েছে। ওষুধ খাইয়েছে। আমি চোখ মেলবার পর সে বলেছিল, উঃ, বাঁচালে! তোমাকে দু-চারদিন আটকে রেখে তোমার কাকাবাবুর কাছ থেকে দু-চারটে জিনিস আদায় করব ভেবেছিলাম। শেষে দেখছি, মরা মেরে খুনের দায়ে পড়ার মতন অবস্থা! তুমি মরে গেলে আমাদের পুরো উদ্দেশ্যটাই ব্যর্থ হয়ে যেত! যাও বাছা, এবারের মতন ফিরে যাও ঘরে। কী খেলাই দেখালে.! আড়াই দিন অজ্ঞান, অথচ শরীরে মাথায় কোনও চোট নেই। জানো কাকাবাবু, শেষ পর্যন্ত রাজকুমার আমাকে খাতির করে বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছে। কাল দুপুরে। তারপর থেকেই তোমাকে টেলিফোনে ধরবার চেষ্টা করছি।

সন্তুর সঙ্গে কথা শেষ করার পর কাকাবাবু একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। অরিজিতের ওপর তাঁর রাগটাও কমে গেল। সে বেচারা ওই বিষফল খেয়ে অজ্ঞান হয়ে যাওয়াটাই অদৃশ্য হওয়া ভেবেছে। এইজন্যই ঝোপেক্সাড়ে যেসব অচেনা ফলটল ফলে থাকে, তা হুট করে খেতে নেই। নিজের ভুলের জন্য অরিজিৎ যথেষ্ট শাস্তি পেয়েছে।

কিন্তু কাস্তে-পাহাড়ের চুড়ার কাছে যে এসে হঠাৎ হানা দিল, সে কি কোনও ছদ্মবেশী মানুষ, না, সত্যিই ইয়েতি!

কাকাবাবু ঠিক করলেন, আবার ওই পাহাড়ের চুড়ায় একবার যেতে হবে।


সমাপ্ত

إرسال تعليق

অনুগ্রহ করে স্পাম করা থেকে বিরত থাকুন।
Cookie Consent
We serve cookies on this site to analyze traffic, remember your preferences, and optimize your experience.
Oops!
It seems there is something wrong with your internet connection. Please connect to the internet and start browsing again.
AdBlock Detected!
We have detected that you are using adblocking plugin in your browser.
The revenue we earn by the advertisements is used to manage this website, we request you to whitelist our website in your adblocking plugin.
Site is Blocked
Sorry! This site is not available in your country.