এক গুচ্ছ মাধবীলতা- পর্ব-০৪ পড়ুন/link/button
৫.
আফজাল শেখ ও স্নিগ্ধ বাপ ছেলে দুজনেই ডিনারের পর ছাদে বসেছে।বাবা ছেলের সাথে একটু একাকি সময় কাটাতে চায়।আর ছেলে বাবাকে নিজের মনের কিছু কথা বলতে চায়।
আজমল শেখ ছেলের দিকে তাকিয়ে আছে।
"ছেলেটা পুরো তার মায়ের মতো ঠান্ডা সভাবের হয়েছে।কিন্তু মুখের আদল পুরো তার পিতা হাকিম শেখ ওরফে বড়ো শেখের মতো হয়েছে।"দেখতে দেখতে পুরোনো দিনের স্মৃতিচারণ করছে।সে সব কথা মনে করে চোখে জল চলে এসেছে।মন ভরে ছেলেকে দেখছে।হঠাৎই ছেলের মাথায় হাত রাখে,আলতো করে বুলিয়ে দেয়।
মুহূর্তেই মনের মধ্যে কেমন যেন একটা পিতৃ স্নেহ অনুভব করছে।
"বাবা...
তোমার কি মন খারাপ?"
আজমল শেখ ছেলের মুখমন্ডলে হাত বুলিয়ে দেয়।মনে হচ্ছে বহুদিন পর নিজের স্ত্রী সুলতানাকে চোখের সামনে দেখছে।চোখের জলেরা টুপ করে ঝরে পড়ে।
স্নিগ্ধ বাবার মনের অনুভূতি বেশ বুঝতে পারছে।বাবার বাচ্চামোতে স্নিগ্ধ মনে মনে পুলকিত অনুভব করছে।স্নিগ্ধর মনে ও বহু দিন পর পিতৃ স্নেহ দাগ কাটছে।মুচকি হেসে বাবার মুখশ্রী পানে দৃষ্টিপাত করে।
"নাহ তো বাবা।
আজকে আমি অনেক খুশি।আমার কলিজার টুকরো কতোদিন পরে আমার চোখের সামনে এসেছে।"
"কাঁদছো কেন তাহলে।"
"কাঁদছি না তো... এমনি।"নিজেকে সামলে পুনঃরায় বলেন,"তারপর বলো দেশে এসে কেমন লাগছে।"
"এটা ঠিক বলেছো।টাকার পেছনে ছুটে মানুষ যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছে।মাঝে মধ্যে কাজ থেকে একটু অবসাদ নেয়া ভালো।এতে মন মস্তিষ্ক ঠিক মতো কাজ করে।
তা... তুমি কি ওই ঢাকা মেডিক্যালেই থাকতে চাচ্ছো?
আমার মনে হয়,তার চেয়ে ভালো হবে নিজে একটা প্রাইভেট হাসপিটাল খুলে নেও।তোমাকে তো কতো করে বললাম বিজনেসটা দেখো।কিন্তু তোমার মন সেবায় নিয়োজিত।
"হ্যাঁ বাবা, সেই বিষয়েই কিছু কথা বলতে চাই তোমার সাথে।"
"আচ্ছা..??
কি বলবে বলো শুনি।"
"এই হসপিটালে আমার কাজ হচ্ছে সপ্তাহে একদিন।আর মেডিক্যাল কলেজে স্টুডেন্টদের সাথে ক্লাস সপ্তাহে এক দিন।বাকি পাঁচ দিন যেখানে ইচ্ছে কাজ করতে পারি।কিন্তু,আমার ইচ্ছে আমি অসহায় মানুষের জন্য কিছু করবো।"
"ঠিক,কি করতে চাচ্ছো?"
"আসলে বিত্তশালীদের জন্য অনেক হসপিটাল আছে। দরিদ্র মিডেল ক্লাস শ্রেণির মানুষেরা টাকার অভাবে বিনা চিকিৎসায় ভোগে। মারা যায়।ভাবছি গ্রামের দিকে একটি হসপিটাল করবো। সেখানে অসহায় মানুষদের ট্রিটমেন্ট হবে।আফটার অল সবাই ট্রিটমেন্ট করাতে পারবে।শুধু দরিদ্র অসহায় লোকজনের ফ্রীতে ট্রিটমেন্ট...আরকি। লন্ডনে আমার পরিচিত এবং প্রিয় জর্জ ফ্রেজার নামে এক জন প্রফেসর আছেন।আমাকে খুব ভালোবাসেন।দেশে ফেরার আগে তার সাথে বিষয়টা নিয়ে কথা হয়েছিল।জর্জ ফ্রেজার খুবই আনন্দিত আমার ডিশিসনে।তিনি নিজে থেকেই আমাকে কিছু ট্রাস্টের কথা জানান।আর আমার পরিচিত কিছু আন্তর্জাতিক ট্রাস্ট ও আছে। সেখানে এপ্লাই করবো। তিনি নিজেই রেকোমেন্ডেশন করবেন এবং আমাকে সেই সব ট্রাস্টের সাথে যোগাযোগ করিয়ে ডোনেশনের ব্যবস্থা করে দিবেন।এখন তুমি যদি বলো...."
"অসাধারণ আইডিয়া...! আ'ম প্রাউড অফ ইউ মাই সন।আজ বুঝতে পারলাম কেন তোমাকে তরুণদের আইডোল বলা হয়।সত্যিই তোমার মতো কৃতি সন্তানরা ই দেশের গর্ব।আমি তোমার সাথে একমত। আমার দিক থেকে তুমি সব রকম সাপোর্ট পাবে। কিন্তু কোথায় করতে চাচ্ছো?সেটা কি ঠিক করা আছে?"
"জি না বাবা।কোথায় করলে ভালো হবে সেটাই ভাবছি।"
"তাহলে আমি তোমাকে বলবো যে আমাদের গ্রামে করো।"
"হ্যাঁ...স্নিগ্ধ।জানো..., বেড়িদিয়া গ্রামের আসপাশের পাঁচ গ্রামে কোনো হাসপাতাল নেই।উপজেলায় কেবল একটা ছোটো খাটো স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।সেখানের চিকিৎসা সেবা নামে মাত্র।নেই বললেই চলে ।তাই সবাই কে দীর্ঘ পথ পারি দিয়ে শহরে ছুটতে হয়।আর শহরে আসতে আসতে রোগীর অবস্থা খারাপ হয়ে যায়।অনেক সময় মারা ও যায়।"
"তাহলে এখনো অবদি ওই গ্রামে একটা ও হসপিটাল হলো না কেন? উপরি দপ্তরের এটাতে তো আরো আগেই দৃষ্টিপাত করা উচিত ছিলো।"
"হ্যাঁ হয়নি।কারণ যাতায়াতের সুবিধা নেই।আর সরকারি দপ্তরের কথা বাদ দেও।একটা স্কুল পর্যন্ত ছিলো না।আমরা ই তো একটা স্কুল খুলে দিলাম।তার আগে তো সেখানের ছেলেমেয়েরা উপজেলার স্কুলে গিয়ে পড়তো।"
"বুঝলে বাবা,আসলে সব হচ্ছে দেশের সরকারি অধিদপ্তরের মহাপরিচালকদের কারসাজি।যেখানে স্কুল কলেজ হাসপাতাল করলে পকেট ভারী হবে সেখানে করবে।গ্রামে করলে তো আর ব্যাংক ব্যালেন্স বাড়ি গাড়ি হবে না।"
"এটার ও তো সলিউশন আছে বাবা ,তাই না?"
"হ্যাঁ আছে।আমি ফ্যাক্টরির কাজের আগে উপরিদপ্তরে কথা বলেছি।তাদের সাথে কনট্রিবিউট করেছি।শহর থেকে সরাসরি যে রাস্তা টা আছে ওইটার কাজ শুরু করবে। আর পথিমধ্যে একটা নদী পড়ে তার উপর ব্রিজ স্থাপন করতে হবে।তাহলে গ্রামীণ জনপদের অগ্রগতি হবে।সেটার জন্য আমি পাঁচ কোটি টাকা দিয়েছি।বাকিটা উনারা করবেন।"
"তাহলে তো তুমি আমার লক্ষ্যের সিড়ি তৈরী করেই রেখেছো।আমার আর কোনো ঝামেলা ই রইলো না। আমি এখন তাহলে আমার কাজ শুরু করতে পারি।ট্রাস্ট গুলোতে এপ্লিকেশন করে ফেলি।কি বলো বাবা।"
"হ্যাঁ করতে পারো। তবে গ্রামের কোন স্পটে করবে।কোথায় করলে ভালো হবে তা তুমি সরজমিনে দেখে এসো।আর গ্রামটা ও ঘুরে এসো।"
"জি বাবা।তাহলে তুমি কথা বলো।এই সপ্তাহের ডিউটি ও ক্লাস আগামীকাল শেষ হবে। পরশু আমি গ্রামে যাচ্ছি।"
মাজিদা বেগম চুলায় দুপুরের রান্না চড়িয়েছে।মধু তার দলবল নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ আগে পুকুর পারে গেছে।কড়ি ও বাবলু এসে মরিচ পোড়া,লবণ আর বটি নিয়ে গেছে।
"মাধবীলতা... "
দৌড়ে হাজির"জি মা... কিছু বলবে?"
"সারাদিন খালি টইটই দিয়া ঘুরিস।দুই দিন পরে না তোর পরীক্ষা।পড়তে বছ তুই। পরীক্ষা খারাপ করলে বাড়ি থেইক্কা তাড়াই দিবো।"
"না মা আমি তো পড়ি। সকালেই না পড়তে বসলাম।তারপর না বাইরে ঘুরাফেরা করতে গেলাম।"
"হ্যাঁ সে দেখা আছে আমার। কেমন পড়া পড়ছস।তা কার গাছের কি চুরি করে আনছোছ।"
"চুড়ি বলো কেন মা।ওইটা তো আমরা চাচা-চাচী,জেঠা-জেঠীদের গাছের টা পাওনাই।ঐ একটুখানি তো কাঠবিড়ালিতে ই খেয়ে নেয়।"
"হ বলছে তোরে।গ্রামের সবার গাছের টা ই তুই পাওনা!অজুহাত দেখানোর জায়গা পাছ না। আমার সাথে ও শুরু দিছোস।যদি খালি বিচার আসে।এই রান্নার চেলি কাঠ তোর পিঠে ভাঙ্গবো বলে দিলাম।"
"আমরা তো কোনো চুরি করি নাই।খালি কুদ্দুস চাচার কলা খেতের ..... না মা কিছু না।একটু পরে আসতেছি।"বলেই উল্টো দৌড়।
মাজেদা মেয়ের যাওয়ার পানে চেয়ে আছে। তিনি বেশ জানে তার মেয়ে আর মেয়ের দলটা কতটা লেজবিশিষ্ট।
ঘন্টা খানিক পর।
বাবলু একবাটি ভর্তি কাঁচাকলার ভর্তা নিয়ে হাজির।
"আম্মা নেও খাও..."
"এই সব চুরির জিনিস আমি খাই না।যা এখান থেইকা।না হয় ওর মাইর তোর পিঠে ও পড়বো।"
"আম্মা অনেক মজা হইছে।সাথে গাছ থেকে পারা পাঁকা তেতুল ও দিছে।ঝালঝাল হইছে।আমার তো এক বার খাইয়া ও আবার জিহ্বায় পানি আইসা পড়ছে।নেও... নেও...খাও...।"
মাজিদা উঠে দাঁড়ায়।রান্নার চেলি কাঠ উঁচিয়ে তেড়ে আসে।বাবলু ভয়ে পুকুর পারে দৌড় লাগায়।
কড়ি মধু টিপু উপস্থিত সকলের খাওয়া শেষ। পরিকল্পনা চলছে শেখ বাড়ির আম বনের ভিতরে একটা বার মাসি মিষ্টি তেঁতুল গাছ আছে।ঐ গাছে কম বেশি সব সময়ই কাঁচাপাকা তেঁতুল ঝুলে থাকে।ঐ গাছের তেঁতুল ওদের ভিষণ প্রিয়।বিশেষ করে মধু আর কড়ির।ওরা ঐ গাছে তেঁতুল চুরি করবে।ঐ গাছের তেঁতুল শেখ বাড়ির লোকজন নিজেরা ও খায় না। আর কাউকে দেয় ও না।এমনি পড়ে পড়ে নষ্ট হয়।
মধু বলছে,"শোন ওদের গাছের কতো তেঁতুল নষ্ট হয়ে যায়,তাই না! এতে তো ওদের পাপ হয়।তেঁতুল গুলো নষ্ট হয়ে যাওয়া থেকে আমরা বাঁচাবো।এতে ওদের পাপ অনেক কম হবে।আর আমাদের অনেক পুণ্য হবে।বুঝেছিস?"
কড়ি:-এইটা তো বুঝলাম।কিন্তু শেখ বাড়ির ঠিকাদার টা কিন্তু অনেক মুখচটা আছে।ধরতে পারলে ধর থেকে কল্লা আলাদা।সোজা বাড়িত বিচার দিবো।বাড়ির লোকজন একেবারে জীবন শেষ কইরা দিবো।
সবাই বলে উঠে ," ঠিকি বলছো কড়িপা।"
মধু বিজ্ঞদের মতো ফের বুঝায়,"শোন সবাই।আমরা তো বেলা হতে যাবো না।যাবো হচ্ছে,ভোর বেলা।এই শীতের ভোরে কি কেউ কম্বল ছেড়ে বের হবে নাকি!গাধারা!বুঝিস না কেন!
আর ঐ ঠিকাদার বুইরা তখন মরার মতো পড়ে ঘুমাবে।বুঝেছিস?"
টিপু শিষ্যের মতো বলছে,"হ... আপা বুঝছি।"সবাই ওর সাথে মাথা নাড়ে যে ব্যপারটা পুরোপুরি বুঝেছে তারা।
এরি মধ্যে বাবলু কে হন্তদন্ত হয়ে আসতে দেখে,উপস্থিত সকলে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়।বাবলু মুখ খোলার আগেই মাজেদা উপস্থিত।
হাতের চেলি কাঠ দেখে সকলেই ঢোক গিলছে।
মাজিদা সবার চুপসে যাওয়া মুখে দৃষ্টিপাত করে,পাশে তাকাতেই চোখ কপালে।
"একি..... এতো বড়ো কলার ছড়ি নিয়ে আসছিস!এমন ডাকাতি কেম্নে করলি তোরা।"
"মা...!
আমরা... তো!
মানে....! আমার তো...চুরি করি নাই মা।"
কড়ি বলতে শুরু করছে,"চাচী কালকা যাইয়া বইলা দিমু।এটারে কোনো চুরি বলে।"
"চুরি কারে বলে আমারে শিখায়তে আসছোস। বান্দরের দল দাঁড়া।"আবারও তাড়া করে।এবার সব কটা ভয়ে ছুটে পালায়।
মধু আর বাবলু দুজনেই ঘরে গিয়ে চুপচাপ বসে আছে।সারাদিন আর বাড়ি থেকে কেউ বের হয়নি। দলবল গুলো ও ভয়ে আর এমুখো হয়নি।
রহমত আলি রাতে বাড়ি ফিরে মাজিদা বেগম কে বলছে,"শেখ বাড়িতে শহর থেইকা মানুষ আইবো।আজমল শেখ দোকানে লোক পাঠাইছিলো।বলছে যতদিন উনারা থাকে প্রতিদিন পাঁচ কেজি গরুর দুধ,তিন চারটা হাঁস-মুরগি,আর পুকুর থেইকা বড়ো মাছ ধইরা পাঠাইতে।"
"কে আসবো শহর থেইকা?আফজাল শেখ আর উনার বউ নাকি?"
"ওই গুলান কিছু জানিনা।শুধু বলছে বিদেশে ফেরত শেখ সাহবে আসবো। সম্ভবত উনার পোলা আইবো।ওনার একটা পোলা নাকি বিদেশে থেইকা বড়ো ডাক্তারি পড়া পইড়া আসছে।"
মধু:-বাবা ডাক্তার হতে গেলে কি বিদেশে গিয়ে পড়া লাগে?
"আমি তো অত কিছু বুঝি না মা।"
মাজিদা:-হ... বড়ো সার্টিফিকেট পাইতে হইলে দূর দেশে যাইতে হয়।ভোরে উইঠা পড়তে হইবো।ঘুমা গিয়া।যা....।