এক গুচ্ছ মাধবীলতা- গল্প কন্যা (পর্ব-০৬) |
এক গুচ্ছ মাধবীলতা- পর্ব- ০৫ পড়ুন/link/button
৬.
মধু ঘুম থেকে উঠে ফজরের নামাজ আদায় করে।তারপর মায়ের সাথে হাতে হাতে খামারের কিছু কাজ করে।আজকে কোচিং বন্ধ।ছুটির দিন তাই বাগানের কিছু কাজ করতে হবে।
সে মোতাবেক দ্রুত হাতে আগাছা গুলো পরিষ্কার করে।সব গুলো গাছের গোড়ায় পানি দেয়। শীতের আগমনে সব গাছে গাছে ফুলের কুড়ি এসেছে।কিছু গাছ তো ফুলে ফুলে ভরে উঠেছে।মূল ফটকের কাছে রোপন করা মাধবীলতা গাছটায় কদিন হলো ফুল ফুটছে।
মনোযোগ দিয়ে মধু ফুল গুলো পর্যবেক্ষণ করছে,"এক একটা থোকায় লাল,সাদা,গোলাপি ও মিশ্র রঙের ৮ ১০টি করে ফুল ফুটেছে।প্রতিটি ফুলে ক্ষুদ্রাকৃতির পাপড়ির সংখ্যা পাঁচটি। মাঝে পরাগ অবস্থিত।দলনল বেশ লম্বা। ওই সব প্রস্ফুটিত বর্ণিল ফুলগুলো থেকে মিষ্টি গন্ধ বের হচ্ছে। শুধু কি তা-ই? অজস্র ফুটন্ত ফুলের সৌন্দর্য মধুর নজর কাড়ছে।উফফ! কি স্নিগ্ধ আর মনোরম!"
আলতো করে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছে।এই ভোর বেলাতেই মধুর মনটা খুশিতে নেচে উঠেছে।
"মাধবীলতা..."
মাজেদার ডাক পড়ে।সঙ্গে সঙ্গে মায়ের ডাকে ছুট লাগায়।
"কি মা?"
"আজকে না তোর কোচিং ক্লাস বন্ধ।আয় চুল গুলো আচড়ে ভেষজ তেল দিয়া দেই।পরে রোদ উঠলে মাথা শ্যাম্পু দিয়া ধুয়ে দিবো নে। মোড়ার উপর দাড়া।"
খুব বড়ো আর ঘন হওয়ায় প্রতিদিন চুলের যত্ন করা হয়ে উঠে না। ছুটির দিনে মাজিদা নিজে হাতে সব করে দেয়।
মধু মায়ের কথা মতো দাঁড়িয়ে যায়।মাজিদা কাঠের মোটা চিরুনী নিয়ে যত্ন সহকারে মেয়ের চুল আচারে দিতে থাকে।মেয়ের এই বিরল কেশো রাশির যত্নে কোনো ত্রুটি রাখে না তিনি।যখন ই রেশমের মতো দীর্ঘ ঘন কালো চুলের যত্ন করে,ভেতরে কেমন যেন গর্ব অনুভব করে।ভেতরটা আনন্দে আপ্লূত হয়ে উঠে।
"এমন রূপবতী মেয়ে স্রষ্টা কেন যে তাদের মতো গরীবের ঘরে দিলেন।এমন রূপ নিয়ে বড়ো ঘরে জন্ম হলে মেয়েটার ভবিষ্যত কতোই না ভালো হতো।আমরা কি পারবো মেয়েটার উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দাড় প্রান্তে মেয়েটাকে পৌঁছে দিতে?পারবো এই পবিত্র নিষ্পাপ সৌন্দর্য কে লোভাতুর পিশাচদের কাছ থেকে রাক্ষা করতে? আল্লাহ তুমি সহায়ক হও। তোমার রহমত দ্বারা তোমার এই নিষ্পাপ বান্দারে বেষ্টন করে রেখো।"
অন্যমনস্ক হওয়ায় চুলে টান পড়ে।
"আহহ...!
মা... ব্যথা লাগে তো!"
"লাগছে মা!আর লাগবো না।এই তো শেষ। তুমি দাঁড়াও,আমি ভাতের মাড়টা ফেলে আসি। তোমার আব্বা তো আবার দোকানে যাইবো।বেলা উঠতে আর বেশিক্ষণ নাই।"
মাজেদার প্রস্তানের সঙ্গে সঙ্গে ফটকের কাছে শিষ বাজানোর শব্দ হচ্ছে।মধুর বুঝতে বাকি নেই কে এসেছে।মাজেদা আসার আগেই দ্রুত লম্বা চুল গুলো কোনো রকম কয়েক পাক পেঁচ দিয়ে ঘরের দিকে ছুটে।ঘরে ঢুকে সাজাগোজ করার ও প্রসাধনী রাখার কাঠের আয়না যাকে ইংরেজিতে ড্রেসিং টেবিল বলে। ওই ড্রেসিং টেবিলের উপর একটা ফ্লাওয়ার ভাস্কে বেশ কটা কাঠের ও লোহার কাটা রাখা আছে। এই ভাস্কের সব গুলো কাটা ওর বাবা নিজে দোকানে বসে থেকে,কাঠ ও লোহা দিয়ে বিশেষ ভাবে বানিয়ে এনেছে।বাজারের কেনা কাটা ওর ঘন চুলে প্রবেশ করানোর আগেই ভেঙে দু টুকরো হয়ে যায়।কারুকাজ করা কাঠের একটা কাটা তুলে মাথায় গুঁজে নেয়।চুপিসারে ফটক ঠেলে বেড়িয়ে যায়।বের হতেই দেখে কড়ি আর টিপু দাঁড়িয়ে আছে।বাকিদের না দেখতে পেয়ে ভ্রকুঞ্চিত করে।
অপ্রসন্ন হয়ে নিচু স্বরে বলে,"বাকি গাধা গুলো কই?"
কড়ি ও একি ভাবে বলে উঠে,"আর কইছ না!সব কয়টা নাক ডাইকা ঘুমায়।আচ্ছা এই গুলার কথা বাদ দে।চল তাড়াতাড়ি না হয় দেরি হইয়া যাইবো।"
টিপু:-হ আপা,চলো।না হয় ঠিকাদার বুইড়া আইসা পড়বো।
"গাধা গুলারে খালি সামনে পাই।কান ছিঁড়ে ফেলবো..."
বৈচিত্র্যেপূর্ণ দেশ বাংলাদেশের ছয় ঋতুর মধ্যে শীতের অবস্থান হেমন্তের পর আর বসন্তের আগে। গাছের পাতা ঝরিয়ে ঘটেছে শীতের আগমন। শীতকাল প্রকৃতির অন্যরকম রূপ, যা সম্পূর্ণভাবে ধারণ করে শীতের সকাল। তেমনি শীতের একটি সকাল উপভোগের সুযোগ হয়েছে আজকে।ছুটি পাওয়ায় আর তেঁতুল চুরির সুবাদে স্নিগ্ধ একটি সকালের স্পর্শ অনুভব করা সম্ভব হচ্ছে ওদের। নয়ত ভোরে বেলা উঠেই বই নিয়ে বসতে হয়।
বিন্দু বিন্দু শিশির পেরিয়ে তিন জন কিশোর কিশোরী চাপা উত্তেজনা ও উল্লাসে এগিয়ে যাচ্ছে আমবনের উদ্দেশ্যে।
কুয়াশার চাদরে আজকে চারিপাশ বেশ ভালোই আচ্ছাদন করে রেখেছে।আর পরিবেশকে করে তুলেছে মনোরম।এই কুয়াশার চাদর ভেদ করে চারদিকে অল্প অল্প সোনালী আলো ছড়িয়ে পড়ছে।
কিছুক্ষণ পরে এই সোনালী আলোয় বাড়িঘর, গাছপালা ও প্রকৃতি ঝলমল করে ওঠবে।এত কুয়াশার কারণে ভোর বেলা পাখিরাও নীড় ছেড়ে বের হয় না, কোলাহলে মেতে ওঠে না।
নেহাত তেঁতুল চুরির টানে বেড়িয়েছে।বড়ো মাঠ পেরিয়ে যাওয়ার সময় চারিদিক থেকে ভেসে আসেছে সরষে ফুলের মধুর সৌরভ।
স্নিগ্ধ গতরাতে ঢাকা থেকে গ্রামে এসেছে।সারাদিনের কাজের চাপ,তার উপর রাস্তা খারাপ হওয়ায়,দুই ঘন্টার রাস্তা তিন ঘন্টায় পারি দিতে হয়েছিলো।সব মিলিয়ে ক্লান্তি অনুভব করায় রাতে দ্রুত ঘুমিয়ে পড়েছিল।
ভোর বেলায় স্নিগ্ধর ঘুম ভেঙে যায়।এই সাত সকালে কেউ জেগে নেই।তাই কাউকে ডাকাডাকি করতে ইচ্ছে করেনি।ভাবলো সব সময় তো ওয়ার্ক আউট করে,আজ যেহেতু করতে পারবে না ,তাই মেঠো পথ ধরে হেটে আসা যাক। নির্জনতা উপভোগ করতে চায়,তাই একা একাই প্রকৃতি বিলাস করতে বেড়িয়ে পড়ে।
হালকা কুয়াশার চাদরে আবৃত চারিপাশ।
হাঁটতে হাঁটতে চোখ পড়ে,রাস্তায় দুপাশে ঘাসের ডগায় বিন্দু বিন্দু শিশিরের উপর।কি অবলিলায় ঘাসের ডগায় জমা হয়ে আছে।সূর্যের আলো এসে পড়ছে সেই শিশির বিন্দুর উপর।
এক একটা বিন্দুকে স্নিগ্ধর কাছে মুক্ত বলে মনে হচ্ছে।এই শিশির বিন্দু গুলো তার মধ্যে একটা ভালো লাগার আমেজ জাগিয়ে দিয়েছে।এই আমেজটা তাকে ভালো লাগার এক অনন্য জগতে নিয়ে যাচ্ছে।
দীর্ঘশ্বাসের মতো গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে শির শির করে ঠান্ডা বাতাস বয়ে যাচ্ছে। এ বাতাসে পাতাগুলো কেঁপে কেঁপে উঠছে।
চারদিকে বিরাজ করছে এক অপূর্ব স্নিগ্ধতা, কোমলতা। গ্রামের শীতের সকালের চিত্র ভিন্ন। যেটা শহরে অনুভব করা সম্ভব নয়।সূর্যের আলোর তীব্রতা বাড়তে বাড়তে দূর হয়ে যাবে শীতের সকালের আমেজ।
মধু পায়ের সেন্ডেল জোড়া খুলে হাতে তুলে নেয়।খালি পায়ে সবুজ নরম ঘাসের উপর পায়ের ছাপ ফেলে শিশির কণা গুলোকে পদদলিত করতে করতে যাচ্ছে ।পায়ের তলায় শিরশিরে অনুভূতি হচ্ছে।তাই খিলখিলিয়ে হেসে উঠছে।এই কাজটা মধুর খুবই পছন্দের।
আমবনে ঢুকেই দুই কিশোরী টিপুর কাছে গায়ের চাদর দিয়ে কোমড়ে গলার ওড়নাটা পেঁচিয়ে নেয়।এ কথা সে কথা বলতে বলতে বনের ভিতরের দিকে তেঁতুল তলায় এসে পৌঁছায়।চারিদিকে ভালো করে নজর বুলিয়ে নেয়।আগে মধু পড়ে কড়ি গাছে উঠে পড়ে।
কথায় কথায় এক গাদা তেঁতুল পারে।
এক গাদা তেঁতুল পেরে কোমড়ে বাধা ওড়নায় জমিয়ে গিট বেঁধে নেয়।
তেঁতুল পাড়া হলে কড়ি গাছ থেকে নেমে যায়।পর পর মধুও লাফ দেয় নামার জন্য।অমনি ওড়নার গিট খুলে সব তেঁতুল ছড়িয়ে ছিটিয়ে নিচে পড়ে যায়।গাছের একটা চিকন ডালে মাথার চুল আটকে যায়।তাড়াহুড়ো করে জোরে টানাটানি করে।জোর করে চুল থেকে ডালটা বের করে।যার ফলে কিছু চুল ছিঁড়ে গেছে।আর খোঁপাটাও প্রায় আলগা হয়ে গেছে।নিচে নেমে তড়িঘড়ি করে তিন জন নিচে পড়ে যাওয়া সেই তেঁতুল গুলো কুড়াতে শুরু করে। তেঁতুল কুড়োনো যখন প্রায় শেষের দিকে।তখন মধুর মাথায় দুষ্টুমি চাপে।ওদের ভয় দেখানোর জন্য বলে,"কড়ি টিপু শোন...।"
দু'জনেই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকায়।
"ওই যে ঠিকাদার বুইড়া আসতাছে।"বলেই ওদের কে রেখে দৌড়াতে শুরু করে। দৌড় দেয়ার দুই সেকেন্ড পেরোতেই ঢেউ খেলানো সর্পিল রেশমের মতো দীর্ঘকায় চুল গুলো ঝরঝর করে খুলে যায়।মাথার কাটা যে ছিটকে কোথায় পড়ে তার কোনো ইয়ত্তা নেই।
কিছু ক্ষণ পরে মধু দাঁড়িয়ে যায়।কিন্তু কড়ি আর টিপু ভয় পেয়ে দিকবিদিকশুন্যে দৌড়াতেই থাকে।কিছু দূর যাওয়ার পর দু'জনে খেয়াল করে মধু পাশে নেই।দাঁড়িয়ে পিছু ফিরতেই বুঝতে পারে।পুরোটা হচ্ছে পাঁজি মধুর ওদের কে ভয় দেখানোর কারসাজি।
কড়ি কোমড় থেকে তেঁতুল সমেত ওড়নাটা ধরে কুড়োনো তেঁতুল গুলো টিপুর কাছে থাকা চাদরে দেয়।
ওদের দু'জনের ভয় পেয়ে চুপসে যাওয়া মুখ দেখে মধুর পেট ফাটা হাসি আসছে।দু'জনের ভো দৌড় লাগানোর কথা ভাবছে আর খিলখিল করে হাসছে।মধুর দুষ্টমি বুঝতে পারায় দুজনেই বোকা বনে যায়।আর ওদের ওই ভ্যাবলা মার্কা চেহারা দেখে মধু আর ও বেশি হাসতে থাকে।হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যাচ্ছে।দু'জনেই এবার ক্ষেপা ষাড়ের মতো ক্ষেপে গেছে।এটা দেখে মধুর আরও হাসি পাচ্ছে।কোনো ভাবেই কমাতে পারছে না।
নিস্তব্ধ বনে এই খিলখিলে হাসির শব্দ বার বার প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।পুরো বনে এই মনোমুগ্ধকর হাসির শব্দ ছড়িয়ে পড়েছে।এই হাসির শব্দ পুরো বনে এক অসাধারণ ঝনঝনে ছন্দ তুলছে।যা শ্রুতিপথে চমৎকার ভাবে প্রবেশ করছে।মনে হচ্ছে এই অপার ছন্দের তালে প্রকৃতিও নৃত্য করছে।এই নৈসর্গিক চমৎকার শব্দে এক বশীভূত করণীয় ব্যাপার আছে।
মধু পেট চেপে হাসছে।ওর হাসি দেখে ভ্যাবাচেকা খাওয়া দুজন প্রচন্ডভাবে ক্ষেপে গেছে।এখনো ভয়ে দুজনের বুক কাঁপছে।কড়ি মধুর পানে তেড়ে আসছে আর বলছে,"দাড়া শাকচুন্নি ,তেঁতুল গাছের পেত্নী,আজকা যদি তোর চুল ছিঁড়ে তোরে টাক্কু না বানাইছি আমার নাম কড়ি না,আমার নাম নাক কাটা কড়ি।"
কড়ির তেড়ে আসা দেখে মধু হাসতে হাসতে পিছনের দিকে তাকিয়েই দৌড়াতে শুরু করে।প্রায় দশ কদম এগোনোর পরেই হুট করে কোথাও ধাক্কা খায়।
মনে হচ্ছে শক্ত পক্ত কোনো কিছুর সাথে ধাক্কা খেলো।মুহূর্তে মাথা ঝিম ধরে গেছে।ঝিমঝিমে ব্যথা অনুভূতির জন্য চোখ মেলে তাকাতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু কোনো পুরুষালি সুবাস ঘ্রাণেন্দ্রিয়তে ঠেকতে ই চকিতে চোখ মেলে মুখ তুলে চায়।
মুহূর্তেই লজ্জার বিশাল এক তরঙ্গলহরী এসে মধুকে কোথাও ভাসিয়ে নিয়ে যায়......