এক গুচ্ছ মাধবীলতা- সুচনা পর্ব পড়ুন/link/button
সড়ক ধরে এই সব স্কুল মাঠ পেরিয়ে মিনিট দশেক হাটলেই,সড়কের নিকটবর্তী দক্ষিণ দিকের টিনের বেড়ায় ঘেরা দেয়া বাড়িটা ই রহমত আলির বাড়ি।গ্রামের মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ রহমত আলি।সহজ সরল গোছের লোক তিনি। টেনেটুনে পঞ্চম শ্রেণি অবদি পড়েছিলেন।পেশায় একজন মুদি দোকানদার। তিনি ও তার স্ত্রী মিলে বাড়িতে মোটামুটি ধরনের একটা খামারও গড়ে তুলেছেন।তিন সদস্যের পরিবার উনার।তিনি তার স্ত্রী ও এক মাত্র কন্যা।
উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের তনয়া রহমতের স্ত্রী মাজিদা বেগম। পড়াশোনার সুযোগ না থাকায় এসএসসির পর আর পড়া হয়ে উঠেনি।বাবার পছন্দসই বিয়ে করে সংসার শুরু করেছেন।
রূপবতী,গুণবতী,বুদ্ধিমতী মাজিদা বেগম গ্রামে থেকেও বাড়ির পরিবেশ শহরের মতোই গড়ে তুলেছেন।তবে নিজের বুদ্ধিমতা কাজে লাগিয়ে অনেক চড়াই-উৎরাই পার করে আজকে স্বামীর পাশাপাশি নিজেও আত্মনির্ভরশীল।সহজ সরল স্বভাবের রহমত আলির স্ত্রী না থাকলে রহমত আলি আজকে কোথায় থাকতো জানা নেই।এর জন্য বরাবর ই তিনি স্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞ।
স্বামী-স্ত্রীর কলিজার টুকরো এবং তাদের পরিবারের মধ্যমণি,তাদের একমাত্র তনয়া মাধবীলতা।পনেরো বছর বয়সী মাধবীলতাকে ওর মা-বাবা ছাড়া সকলেই মধু ডাকে।এই বার এসএসসি পরীক্ষার্থী মাধবীলতা।রূপে গুণে একাই অষ্টারম্ভি।গোলাপি আভা যেন ঠিকরে পড়ে ওর গা থেকে।ডাগর ডাগর নেত্র পল্লবের অধিকারী মাধবীলতার এক বিশেষ গুণ আছে। সেটা হলো ঘন মেঘ কালো কুন্তলরাশি।বিনুনি না করে পিঠে ছড়িয়ে রাখলে মাটি ছুঁই ছুঁই করে।আর যাই হোক এই বিরল কেশো রাশির জন্য বেড়িদিয়া গ্রামের সবার মুখে মুখে মাধবীলতা।লোক মুখে প্রচলিত,"গোবরে পদ্মফুল এই মেয়ে।রহমত আলির কপালই বটে এমন গুণবতী স্ত্রী আর রূপবতী মেয়ে আছে তার ঘরে।"
দুরন্তপনা,চঞ্চল-চপলতা বিশিষ্ট মাধবীলতার ঠোঁটের কোণে সব সময় এক চিলতে মিষ্টি হাসি দেখা মেলে।পড়াশোনায় খুবই মনোযোগী।আর মনোযোগী খেলাধুলায়।আরো একটা বিশেষ কাজ খুব ভালো জানা তার।সেটা হচ্ছে-অন্যের গাছের ফল চুরি করা।ওর একটা লেজ বিশিষ্ট গ্রুপ আছে,তাদের কে নিয়ে অন্যের গাছের ফল চুরি করে খুব মজা পায়।এমন না যে নিজেদের গাছ নেই।নিজেদেরটা রেখে অন্যের গাছের টা চুরি করে ওরা আনন্দ পায়।বলতে গলে এটা ওদের শখ হয়ে দাঁড়িয়েছে।কতো গালমন্দ শোনে এর জন্য।কিছুতেই কিছু হয় না।আসলে,বেহায়ার রাজ্য কিনা!
এর জন্য ওর মা ওকে মারা বাদ রেখেছে শুধু।কিন্তু শাসনের কোনো কমতি রাখেনি।আদরের মেয়েকে কখনো স্বামী-স্ত্রীর কেউ রাগ করে একটু টোকা ও দেয়নি।
মাজিদা বেগম মেয়েকে যথেষ্ট নম্রতা-ভদ্রতা,শিষ্টাচার,সুশিক্ষা দেয়ার চেষ্টা করেন।মেয়ের পড়াশোনার ক্ষেত্রে তিনি খুব যত্নশীল।নিজের অপূর্ণ ইচ্ছেটা মেয়ের মধ্য দিয়ে পূরণ করতে চান।সব কিছুতে তাদের বাধ্য সন্তান মাধবীলতা।তবে,সব ঠিক থাকলেও,মেয়েটার ছটফটে দুরন্তপনা সভাব বদলাতে পারে না।কখন জানি কার নজরে পড়ে যায়।এখনকার সময়ে তো ছোট্ট দুধের একটা বাচ্চা ও লোভাতুর দৃষ্টি থেকে রক্ষা পায় না।আর তাদের তো শত্রুর অভাব নেই।সবসময় ভয়ে থাকে, না জানি চাঁদের টুকরো মেয়ের কোনো ক্ষতি হয়।
দুপুর ১:৩০বাজে।
রহমত আলি বসে আছে,মাধবীলতা বাড়ি ফিরার পর দুপুরের আহার করবেন।তারপর আবার বাজারমুখি হবেন।দোকান খুলতে হবে।মাজিদা বেগম খাবার ঘরে টেবিলে সব খাবার গুছিয়ে রেখেছেন,মেয়েটা এলো বলে।
মধু হন্তদন্ত হয়ে টিনের ফটক ঠেলে ধুপধাপ শব্দ করে বাড়ির ভিতর প্রবেশ করে।ধুপধাপ শব্দে ই স্বামী-স্ত্রীর টনক নড়ে যায়।এভাবে কে এলো!দুজনেই খাবার ঘর থেকে বের হয়ে মেয়ের মুখ দেখে আত্মকে উঠে।এমন তো হওয়ার কথা না। মাধবীলতা তো বাড়ি এলে এভাবে উদভ্রান্তের মতো ধুপধাপ করে না।বাড়িতে প্রবেশ করে ই প্রথম যে কাজটা করে,জোরে সালাম দেয়।তারপর,মা মা বলে চিল্লাতে থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত না মাজিদা সামনে এসে দাঁড়ায় ততক্ষণ পর্যন্ত।
কিন্তু আজকের চিত্র ভিন্ন।দুজনেই উঠানে আসে।
খেয়াল করে মেয়ের মুখ চুপসানো। জল ছলাৎ ছলাৎ চোখ।গাল ভিজে আছে।
বাবাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠে।মধু কখনো হাউমাউ করে কাঁদতে পারে না।ওর কেন যেন তেমন করে কান্না আসে না।মেয়ের চোখের পানিতে রহমত আলির শার্টের খানিকটা ভিজে গেছে।মেয়ের মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে,কান্নার কারণ জানতে চাইছে।আদুরে স্পর্শে বিড়াল ছানার মতো বাবার বুকে লেপ্টে বাচ্চাদের মতো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।থেকে থেকে ফুঁপানোর গতি বেড়ে যাচ্ছে।
মেয়ের এহেন কান্ডে মাজিদা বেগমের বুকের ভিতর মুচড়ে উঠে।অজানা শঙ্কায় হৃদপিণ্ড কেঁপে উঠে।
স্বামী-স্ত্রী দুজনই বিচলিত হয়ে পড়েছে।
ফুঁপাতে ফুঁপাতে বাবা-মা কে পথিমধ্যে ঘটা ঘটনা বিস্তারিত বলে।মেয়ের কথা শুনে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই তীব্র ক্রোধে ক্রোধান্বিত হয়ে যায়।
"অনেক দেখা হইছে।চেয়ারম্যানের পোলা দেইখা কি হইছে!আজকা এর বিচার করতে ই হইবো।"
"মাথা ঠাণ্ডা রাখেন।অতি ক্রোধে বুদ্ধিনাশ।আপনে গিয়া,আজমল শেখ রে ভালো করে বুঝাই বলেন।রাগারাগি করলে হিতে বিপরীত হইবো।"
__________
"সুডৌল দেহের অধিকারী চঞ্চল চপল এক তরুণী,ঝংলি ছাপের শাড়ি পড়ে কারো হৃদয়ে ছন্দ তুলে হেটে যাচ্ছে।আবছা আলো অন্ধকারে দুধে-আলতা গোলাপি আভা যেন তার গা চুঁইয়ে পড়ছে।মনে হচ্ছে ছুঁলেই বুঝি তার টকটকে রক্তাভ কোমল গায়ে ছাপ বসে যাবে।।তার পিঠে ছড়িয়ে রেখেছে দীঘল কালো কেশো রাশি।
কি অসাধারণ রেশমের মতো সুন্দর ঝলমলে কেশোরাশি!
চোখ ফেরানো দায় হয়ে পড়েছে!
কেশো রাশিতে গুঁজে রেখেছে এক গুচ্ছ লাল সাদা গোলাপি মিশ্রিত মাধবীলতা ফুল।মাধবীলতা ফুলের গুচ্ছটা যেন তার কেশো রাশিতে গোঁজার জন্যই ফুটেছে।আজ এই রূপকথার রূপবতীর কেশো রাশিতে চেপে বসে,এই সাধারণ ঝংলি ফুলের শোভাও মনে হচ্ছে হাজার গুণ বেড়ে গেছে।
প্রস্ফুটিত সেই মাধবীলতার মিষ্টি সুবাস,এক সুদর্শন পুরুষকে তার মোহে আচ্ছাদন করছে।মোহাবিষ্ট মরনকোপে ঘায়েল করছে তার হৃদয়।হাতছানি দিয়ে তার পানে আহ্বান করছে।
"কে এই মেয়ে?কি নাম তার? ডাকবো কি নামে।নাম তো জানি না।"
"কে তুমি?তোমার নাম কি?"
মেয়েটি খিলখিলিয়ে হেসে উঠে।এ যেন হাসির শব্দ নয়। কোনো এক মরণকোপ।যার মুগ্ধতা একটু একটু করে গ্রাস করছে তার পুরো স্বত্তাকে।কম্পন তুলে দিয়েছে তার হৃদয়ে।
কানের কাছে গোঁজা মাধবীলতা ফুলের গুচ্ছটি আলতো করে হাতে তুলে নেয়।আবছা আধারে বাড়িয়ে দেয় নিশপিশ করতে থাকা সুদর্শন পুরুষের পানে।
"মাধবীলতা...
তুমি কি মাধবীলতা?
চুপ করে থেকো না!
বলো?"
আবারো কাঁপন তোলানো সেই মনোমুগ্ধকর হাসি।একটু একটু করে আবছায়াতে হারিয়ে যাচ্ছে।
"দাঁড়াও মাধবীলতা।কেন এই লুকোচুরি? "
কেনো বারবার ধরা দিয়েও দেয় না?
এগিয়ে যাচ্ছে একটু ছুঁয়ে দেখার অভিলাষে।
কিন্তু ধরতে গেলেই কোথাও হারিয়ে যাচ্ছে।আর হৃদয় তোলপাড় করে সেই খিলখিল হাসিতে হেসে উঠছে।
"মাধবীলতা...
কোথায় যাচ্ছো তুমি?
তোমায় যে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে!
বড্ড ছুঁতে ইচ্ছে করছে।অতৃপ্ত রেখে হারিয়ে যেও না...প্লিজ।"
মেয়েটি থমকে দাঁড়ায়,গাড় ঘুড়িয়ে তাকায় ।
"এ কি ভয়ংকর সৌন্দর্য! ডাগর ডাগর নেত্রদ্বয় যেন কোনো মোহাবিষ্ট দৃষ্টিতে চেয়ে আছে!"
মনে হচ্ছে পুরো পৃথিবী স্তব্ধ হয়ে গেছে।ডাগর ডাগর আঁখিজুড়ে কেবল স্বচ্ছ নির্মল স্নিগ্ধতা।মায়াবী আঁখিদ্বয় কেবল তার পানে আহ্বান জানাচ্ছে তার নিজস্ব ছলে।
"মাধবীলতা!এ কোন মায়ার চাদরে আচ্ছাদিতো করলে আমায়?"
তীব্র অভিলাষে একজোড়া সুন্দর চোখের অধিকারী এক বশীকরণীর দিকে অগ্রসর হচ্ছে।এক আবেদনময়ী নারী তার সৌন্দর্যের ঝলকানিতে ঝলকে দিয়েছে কারো কোঠর হৃদয়।প্রবল জলোচ্ছ্বাস ঘটিয়েছে তার মনোসপটে।তার মায়ার জালে আটকে,খিলখিলিয়ে হাসতে হাসতে আবছা আলো আধারে মিলিয়ে যাচ্ছে ।
"দাঁড়াও... মাধবীলতা!
দাঁড়াও...!
যেও না... প্লিজ।
কোথায় পাবো তোমাকে? বলে যাও?
যেও না...!"
অতৃপ্ত রেখেই মিলিয়ে যায় নারী মূর্তিটি।
"তোমায় ছোঁয়ার সাধ্যি কি আমার হবে না?"
সুদূর যুক্তরাজ্যের রাজধানীর লন্ডন শহরে,এক সুদর্শন পুরুষ গভীর ঘুমে মগ্ন।আর মগ্ন হয়ে আছে স্বপ্ন দেখায়।এক অদেখা নরীমূর্তির দেখা পেতে বিভোর সে স্বপ্নে।এ স্বপ্ন প্রায়শই তার ঘুমের ঘোরে দেখা দেয়।আর তার হৃদয় উলোটপালোট করে দিয়ে যায়।এক অতৃপ্ত বাসনার ঝড় তুলে দিয়ে যায় তার চিত্তপটে।
__________
"এখনকার যুগে কেউ এমন আদিকালের রাজকন্যার স্বপ্ন দেখে,তাও আবার লন্ডনের বুকে থেকে!
"আশ্চর্য! আমি কি ইচ্ছে করে দেখেছি নাকি!যাই হোক স্বপ্ন তো স্বপ্ন ই।সেখানে রাজকন্যা হোক কিংবা ফকিন্নি!এটা নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নেই,ইনা।"
"তাই বলে একি স্বপ্ন কেউ বারবার কিভাবে দেখে!তুই একজন ডক্টর হয়ে এটা কিভাবে বলছিস স্নিগ্ধ? হয় তুই মিথ্যা বলছিস,না হয় স্বপ্নে দেখা ঐ মেয়েটিকে তুই চিনিস?"
"আমি মিথ্যা বলছি?এই সাত সকালে হাতের সব কাজ ফেলে তোর সাথে ফাজলামো করছি মনে হচ্ছে তোর?যা তো এখান থেকে।এমনি এই স্বপ্ন দেখলে মেজাজ গরম হয়ে থাকে।মনে হয় কেউ নাকে দড়ি বেঁধে ঘুড়াচ্ছে।"
"আরে আরে ক্ষেপছিস কেনো?তোর স্বপ্নে আমি ছাড়া কেউ আসবে, সেটা ভাবলেই আমার হিংসে হয়।আচ্ছা এই টপিক বাদ।এবার বলো তো,তুই নাকি দেশে ফিরবি?এখানেই সেটেল্ড হয়ে যা না?"
"দেশের ছেলে দেশে ফিরবো।ওখানে ধনীদের জন্য অনেক ডক্টর আছে,কিন্তু গরীব-মধ্যবিত্ত অসহায়দের জন্য কোনো ডক্টর নেই।আমি তাদের জন্য কিছু করতে চাই।পড়তে এসেছি পড়া শেষ ,এখন মাতৃভূমিতে ফিরবো "
"ওয়াও....!
আ'ম প্রাউড অফ ইউ ডিয়ার। তোর এমন চিন্তা ধারার জন্য ই তোকে আমার এতো পছন্দ স্নিগ্ধ।"ইনা শক্ত করে স্নিগ্ধকে জড়িয়ে ধরে।
চলবে....