ধ্রবতারা
লিখিকাঃ গল্প কন্যা (ছদ্ম নাম)
তারপর নিচে লেখা...
যে দিন তোকে প্রথম দেখি,সেদিন চাচা তোকে একটা সাদা তোয়ালে মুরিয়ে নিয়ে এসে ছিলো।সবাই যে কি খুশি।তোকে দেখে সবাই তোকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।আমি ও পাশে গিয়ে দাড়িয়ে দাড়িয়ে দেখছিলাম।কি সুন্দর মুখটা পুরো আকাশের চকচকে একটা তারা আছে না ওটার মতো উজ্জ্বল।নামটা ও জানতাম না তখন।প্রথম দেখা তোর উজ্জ্বল মুখশ্রী টা আমি এখনো ভুলতে পারি না।
আমি চাচাকে জিজ্ঞেস করালাম" চাচা এইটা কে?ওকে কোথা থেকে এনেছেন?
তখন চাচা খুশি হয়ে আমাকে বলে "একে তারার দেশ থেকে এনেছি বাবা,তোমার সাথে খেলবে।"
আমার প্রশ্নের শুরু হয়েছিল।কিন্তু শেষ হচ্ছিল ছিলো না।ওর হাত গুলো এতো পিচ্চি পিচ্চি কেনো?এগুলো দিয়ে খাবে কিভাবে।পা এমন ছোট ছোট কেন এগুলো দিয়ে হাটবে কিভাবে ?ঠোঁট গুলো এমন লাল আর ছোট কেন?এমন করে চোখ পিট পিট করে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তাকায় কেন?
সবচেয়ে মজার ছিলো ঐ ছোট্ট তুই তোর ছোট ছোট চোখ দিয়ে পিট পিট করে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলি।একদম ফেলফেল করে দেখছিলি।আমার কাছে তোকে,পুতুলের মতো একটা খেলনা মনে হচ্ছিল।মনে হচ্ছিল তোকে নিয়ে আমার অন্য খেলনার সাথে রেখে দেই যখন খুশি খেলবো।
সবাই তোকে আদর করছে কোলে নিচ্ছে।দাদি আর আমি বসে বসে দেখছিলাম।মা যখন কোলে নিলো আমি মায়ের কাছে গিয়ে আবদার করি"মা আমি এই পুতুল টাকে কোলে নিবো,ওকে নিয়ে খেলবো।"
মা বলে "তাই বাবা,কিন্তু ওতো খেলনা না ও তো তোমার বোন।"
আমি মানতে নারাজ "নাহ।এ আমার বোন না।পুতুলের মতো দেখতে,আর বউদের মতো কাপড়ে মোরানো একটা পুতুল বউ।ও হচ্ছে আমার পুতুল বউ।"
আমার কথা শুনে ঘর ভর্তি সকলে হেসে ওঠে।
আমি আবার ও বলে উঠি "ও আমার পুতুল বউ আমার পুতুল বউকে শুধু আমি আদর করবো।তোমরা কেউ না।দেও আমার কোলে দেও।"
তারপর থেকে ই তোর প্রতি আমি অন্য কিছু ফিল করতাম। আলাদা মায়া কাজ করতো।
সবাই তোকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরে।আমার আদরে তুই ভাগ বসালি।মাঝে মাঝে রাগ করতাম।আবার ভাবতাম আমার পুতুল বউ ই তো থাক না।
তখন আবার ওদের ওপর রাগ হতো।আমার পুতুল বউকে শুধু আমি আদর করবো অন্য কেউ না।কিন্তু কেউ আমার কথা শুনতোই না।
ছোট বেলা আমার দুটো জিনিস করতে ভালো লাগতো এক বই পড়তে আর দুই তোর সাথে বসে থাকতে তোকে দেখতে।
তোকে দেখে ভাবতাম তুই এতো চকচকে মানে এতো ফর্সা কেন।তোকে কি সত্যি ঐ তারার দেশ থেকে এনেছে।আবার দেখতাম তোকে,ভাবতাম... হবে হয়তো না হয় এতো সুন্দর কেন?ফর্সা কেন?কই আমি ওতো ফর্সা কিন্তু তোর মতো তো এমন চকচকে না।সবার আড়ালে তোর সাথে আমার গায়ের রং মিলিয়ে দেখতাম।
এখন মনে হলে একা একা হাসি।
এক দিন বারান্দায় মায়ের কোলে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ঐ তারাটা কে দেখছিলাম।আর ভাবছিলাম তোর কথা।ভাবতে ভাবতে মাকে প্রশ্ন করি ঐ চকচকে তারাটার নাম কি ওরা ওখানে কি করে?
তখন মা আমাকে বলে "ঐ যে সবচেয়ে বড়ো আর চকচকে যে তারাটা দেখতে পাচ্ছো ওটা হচ্ছে ধ্রুবতারা।আকাশে যখন কোনো তারা থাকে না।অমাবস্যার অন্ধকারে চারিদিক ঢেকে যায়।তখন কোনো তারার দেখা মিলে না।আকাশে তাদের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না।কিন্তু ঐ চকচকে ধ্রুব তারাটা তখনও থাকে থেকে যায়।আকাশে টিমটিম করে জ্বালাতে থাকে।ঐ তারাটা সব তারার মাঝে এক বিশেষ তারা।ঐ তারাটা কে বাংলাতে বলে ধ্রবতারা আর ইংরেজিতে বলে পোলস্টার।এর অস্তিত্ব কখনো বিলিন হয় না।বুঝলে বাবা।সকলের মাঝে স্পেশাল তারা ওটা।"
সেদিন আমি ঐ ধ্রুবতারা টার দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম।তুইও তো এমন চকচকে আমাদের সবার থেকে আলাদা।তাহলে তুই ও আমার ধ্রুবতারা আমার পোলস্টার।
তুই বাড়িতে আসার পর বাড়ির পরিবেশ অন্যরকম হয়ে গেল।সবাই সব সময় তোকে নিয়ে ব্যস্ত।তোর কেয়ার করতে ব্যস্ত থাকত।তুই একটু একটু করে বড়ো হচ্ছিলি আর তোর আদর ততো বাড়ছিল।আর আমি ততই সবার থেকে দূরে সরে যাচ্ছিলাম।তোর মুখে আধো আধো বুলি ফুটছিল।সবার আদরের মাত্রা আরো বেশি বাড়ছিল।আর আমার সকলের প্রতি রাগ বারছিলো।
আমি ঘর কুনো হয়ে যাচ্ছিলাম।বই পড়তাম মাঝে মধ্যে তোকে কোলে নিতাম।মাঝে মাঝে খেলতে যেতাম আমার বড়ো বড়ো খেলনা গুলো নিয়ে।
কিন্তু তুই খেলতে পারতি না এগুলো দিয়ে।আছড়ে আছড়ে ভেঙে ফেলতি।না হয় এগুলোর উপর পটি করে দিতি।তখন থেকে আর খেলতে ও যেতাম না।
তুই যখনই আমাকে দেখতি ডেকে উঠতি" ধুওওবওও... ধুওওবওও... ধুওওবওও...আয়.... আয়.....।"
আমি সব রাগ ভুলে তোর কাছে যেতাম তোকে কোলে নিতাম।তুই পাজি টা আমার কোলে চড়ে আমার চুলে ধরে ঝুলে থাকতি।আমি চিৎকার দিলে, চুল ছেড়ে আমার দিকে হাবলার মতো তাকিয়ে থাকতি।তখন যদি হাসি দিয়ে বুঝাতাম কিছু হয়নি। আমার গাল খেয়ে নিতে আসতি।আর সারা গালে লালা লাগিয়ে একদম বিচ্ছিরি অবস্থা করতি।
আমি রেগে তখন তোকে নামিয়ে দিতাম আর তুই ভ্যা....ভ্যা....করে কেঁদে দিতি।সবার কাছে নালিশ করতি ধুওওবওও...মাচচে...আম্মমা... ধুওওবওও...মাচচে......।সবাই আমাকে কথা শুনাতো।
তোর জন্মের দুতিন মাস পর ফাহিমকে ও নিয়ে আসে সাদা তোয়ালে মুরিয়ে।কিন্তু ওকে তোর মতো এমন চকচকে লাগেনি।তাই ওকে বেশি কোলে নিতাম না।মিলিয়ে দেখলাম ফাহিমের প্রতি অন্য রকম মায়া কাজ করতো।ও আমার ভাই বুঝতে পারতাম।ছোট থেকে আমি সবচেয়ে বেশি তোকে কোলে নিয়েছি।
যখন তুই তোর ছোট ছোট পা দিয়ে থমকে থমকে সারা বাড়ি হাটতি আর আধো বুলিতে সবাই কে ডাকতি সকলেই তোকে প্রচন্ড আদর করতো। তোর সবকিছুই মায়াময় ছিলো কেমন যেন মায়া উপচে পড়তো।যাকে প্রথম বার দেখেছিস তার সাথে ও পাকনামি করতি।তাই সবাই প্রথম দেখাতেই তোকে খুব আদর করতো।আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতাম।তখন অনেকটা বুঝতে শিখেছি তাই আর হিংসা কাজ করতো না।
ফাহিম কিন্তু প্রায় তোর বয়সী কিন্তু ও এতো পাকনামি করতো না।তোর মতো এতো আদুরে ও ছিলো না।সবার কাছ থেকে আদর আদায় করতে জানতো না।
জানিস আমার বই পড়ার প্রতি আগ্রহ বাড়ে তোর জন্য। আকাশে উড়ে বেরাবো পাইলট হবো সেই স্বপ্ন দেখার পেছনে তোর হাত।
মায়ের কাছ থেকে সেদিন ধ্রুবতারার কথা শুনে শুনে ভাবতাম ঐ তারার জগতের কথা।তুই কিভাবে ওখান থেকে এলি আর কি কি আছে?ওখানে কেউ কিভাবে থাকে?আরও কতো কিছু।
একদিন মেঝো চাচার রুমে গিয়ে বসে বসে ভাবতে থাকি।এই ছোট আমি কে চিন্তা মগ্ন দেখে চাচা জানতে চায় কি হয়েছে।আর আমিও বলি আমার ভাবনার কথা।তখন চাচা অনেক হাসে।হাসতে হাসতে বলে "ওটা তো এমনি বলেছি।"সৌর জগৎ সম্পৃক্ত একটা বই দেয় বলে এটা পড়ো।সব জানতে পারবে ওখানে কেউ থাকতে পারে না। আমি বইটা খুলি দেখি ওখানে সৌরজগত সম্পর্কে লেখা আছে।ধ্রুবতারা সম্পর্কে ও কিছু কথা লেখা আছে।আমি সেগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়ি....
ইংরেজিতে পোল স্টার(Pole star)।পৃথিবীর উত্তর মেরুর অক্ষ বরাবর দৃশ্যমান তারা ধ্রুবতারা নামে পরিচিত। এই তারাটি পৃথিবীর অক্ষের উপর ঘূর্ণনের সাথে প্রায় সামাঞ্জস্যপূর্ণভাবে আবর্তিত হয়। প্রাচীন কালে দিক নির্ণয় যন্ত্র আবিস্কারের পূর্বে সমূদ্রে জাহাজ চালাবার সময় নাবিকরা এই তারার অবস্থান দেখে দিক নির্ণয় করতো।সপ্তর্ষী মন্ডল এর প্রথম দুটি তারা, পুলহ এবং ক্রতু-কে সরলরেখায় বাড়ালে সেটি এ তারাটিকে নির্দেশ করে।
একটি ফরাসি "navisphere": একধরনের ভূ-গোলক যা সমুদ্রগামী জাহাজে ব্যবহৃত হত।
রাত বাড়ার সাথে সাথে আকাশের দৃশ্যমান সকল তারা তাদের অবস্থান পরিবর্তন করে । শুধুমাত্র ধ্রুবতারাই মোটামুটি একই স্থানে অবস্থান (দৃশ্যত) থাকে । এটি আকাশের একমাত্র তারা, যেটিকে এ অঞ্চল হতে বছরের যে কোন সময়েই ঠিক এক জায়গায় দেখা যায়।
পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধ থেকে ধ্রুবতারাকে সারাবছরই আকাশের উত্তরে নির্দিষ্ট স্থানে দেখা যায়। দিক নির্ণয়ে এই তারা গুরুত্বপূর্ণ। ধ্রুবতারাকে বেশি উঁচুতে দেখা যায় না। ঢাকা থেকে ধ্রুব তারার উচ্চতা ২৩ ডিগ্রি ৪৩ মিনিট। দিগ্বলয় থেকে আকাশের প্রায় চারভাগের একভাগ উঁচুতেই এই তারাটির মতো উজ্জ্বল আর কোনো তারা নেই বলে একে চিনতে বিশেষ অসুবিধা হয় না। তবে বাংলাদেশ থেকে যতই উত্তরে যাওয়া যাবে, ধ্রুবতারা ততই ওপরে দেখা যাবে।
আমি বইটা মনোযোগ দিয়ে পড়ি ।পড়ে কিছু টা বুঝতে পারি।ততোদিনে তোকে পোলস্টার ভাবা আমার মনে ব্রেনে সেট হয়ে গেছে।ওটা চেন্জ হবে না।এভাবে আমি একবার দুই বার তিন বারবার বইটা পড়ি।বলতে গেলে পুরো বইটা পড়ে মগজ ধোলাই করে ফেলেছি।
আর ওই সৌরজগতের সম্পর্কে আগ্রহ বাড়ে। মন চায় ওই আকাশে উড়তে।আমি আবার ও চাচার কাছে যাই আরো বই নিয়ে আসি সৌরজগত সম্পৃক্ত।
পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি শুধু সৌরজগত আকাশ ভ্রমণ পাইলটদের আর্টিকেল গুলোতে ডুবে থাকতাম।আর তোর কাছে যেতাম কোলে নিতাম তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতাম।আমার চকচকে অনন্য ধ্রুবতারা টাকে।আমার জীবনের পথপ্রদর্শক কে।
আমার খেলনার বেশি ভাগ খেলনা তোদের কে দিয়ে দিয়ে ছিলাম।বিমান পাইলট হেলিকপ্টার এই সব বেরাইটিস আটেম ছিলো আমার খেলার জিনিস।এভাবেই আমার মনে আশা জাগে ঐ আকাশে উড়ার।মনে জেদ চাপে প্রথমে আকাশে উড়বো।তারপর আমার ধ্রবতারা কে নিজের আকাশের একমাত্র.....
"তুই আমার লেপটপে কি করছিস"
তুর চমকে যায় দ্রুত ফাইল থেকে বের হয়।পাশে তাকিয়ে দেখে তুহিন ঘুমিয়ে পড়েছে।স্ক্রিনের কোনায় তাকাতে দেখে নয়টা বেজে গেছে।কখন যে পড়তে পড়তে ঘোরে চলে গিয়েছিল টের ই পায়নি।
ধ্রুব রুমে ঢুকে পুনরায় প্রশ্ন করে"আমার লেপটপ এখানে কেন?কি করছিস লেপটপে?
চলবে.....