ধ্রবতারা
লিখিকাঃ গল্প কন্যা (ছদ্ম নাম)
তখনই জিসান রুমে ঢুকে আর এই দৃশ্য দেখে ফেলে... ... ...
ধ্রুব ধরা পড়া চোরের মতো হতভম্ব হয়ে যায়।জিসান তো আশ্চর্যের শেষ সীমানায়।ধ্রুব এটা কি করলো?কেন করলো?এর মানে টা কি?হাজারো প্রশ্ন মনে উকি দিচ্ছে।কপাল কুচকে তাকিয়ে আছে।
ধ্রুবকে প্রশ্ন করে "এটা কি ছিলো?অবশ্যই কোন ভালো উদ্দেশ্যে এভাবে লুকিয়ে চুমো খাসনি।"
ধ্রুব জিসানের দিকে তাকায়।ভাবে পুরোটা জানার পর ছেলেটা কতটা কষ্ট পাবে।কিন্তু এক দিন তো জানাতেই হবে। হয়তো এখনি সঠিক টাইম।
"তোকে আমার কিছু বলার আছে।"
"ভনিতা ছেড়ে... বল।"
"আমি তুরকে ভালোবাসি।"
জিসান যার পর নাই অবাক।এ কি শুনছে প্রিয় বন্ধুর মুখ থেকে পছন্দের মানুষকে ভালোবাসার কথা। বিশ্বাস করতে পারছে না।
"কি বলছিস,ফাজলামো করা বন্ধ কর দোস্ত।তুই জানিস আমি ওকে কতোটা পছন্দ করি।প্লিজ এটা নিয়ে মজা করিস না।"
দীর্ঘশ্বাস ফেলে "আমি এখন ফাজলামোর মুডে নেই।আ'ম সিরিয়াস জিসান।সত্যি আমি ওকে ভালোবাসি।এক দিন দুদিন বা এক দু'বছর ধরে না সেই ছোটো বেলা থেকে।"
"আগে বলিস কেন?"
"ভেবেছিলাম কোনো ভাবে বিয়েটা আটকে যাবে।তোর মনটা ভেঙে দিতে চাইনি।"
"তুরিন তোকে ভালোবাসে?"
"ওর চোখ বলে বাসে।কিন্তু মুখে বলেনি।দোস্ত তুই তো শুধু পছন্দ করিস আর আমি আমি ওকে ছাড়া মরে যাবো।কিভাবে আঙ্কেল আর তোকে বলবো ভাবে পাচ্ছিলাম না।তাছাড়া আসার পর থেকে একটার পর একটা ইনসিডেন্ট আমাকে আর ওকে শুধু দূরে সরিয়ে রাখছে।"
"কেমন ভালোবাসিস যে এতো বছরে ও বলতে পারিসনি।নিজের করে রাখতে পারিসনি।"
"বাসি দোস্ত নিজের সবটুকু উজাড় করে দিয়ে ভালোবাসি।কিন্তু একটা ভুল বোঝাবুঝি থেকে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়,যে আজও পর্যন্ত কিছু ঠিক করতে পারিনি।ও আমাকে সেই সুযোগ টুকু দিচ্ছে না।ভুল বোঝাবুঝি শুধু বাড়ছেই দোস্ত কোনো ভাবে কমাতে পারছি না।"
জিসান স্তব্ধ হয়ে বসে আছে এই মুহূর্তে কি করা উচিত।বন্ধুর জন্য নিজে স্যাক্রিফাইস করবে।নাকি নিজেরটা নিজে আদায় করে নিবে।
"ভাই আমি বুঝতে পারছি তোর মনের অবস্থা।বিশ্বাস কর ওকে ছাড়া পৃথিবীর যে কোন কিছু চাইবি,চোখ বন্ধ করে দিয়ে দিব।"
জিসান ভাবছে "আমি শুধু কয়েকটা দিন ধরে পছন্দ করি।তাও সেটা এক তরফা।এখনো সেটা ভালোবাসায় গড়ায়নি।চেষ্টা করলে হয়তো একদিন ভুলতে পারবো।এরা দুজন তো কবে থেকে একজন আর একজনকে ভালোবেসে।আমি কেন মাঝখানে বাধা হয়ে দাড়াবো।"
ধ্রুব বন্ধুর থমথমে মুখশ্রীর দিকে তাকায়।চোখ দুটো রক্তবর্ণ ধারণ করে আছে।হয়তো কাঁদতে পারছেনা বলে।পেয়ে ও না পাওয়ার যন্ত্রণা যে কতোটা পোরায়,ধ্রুবর চেয়ে ভালো কেউ জানে না।
জিসান কে ডেকে উঠে "জিসান...জিসান...কিছু বল। তোকে এভাবে দেখে আমার কষ্ট হচ্ছে বন্ধু।প্লিজ হাম্বাল রিকোয়েস্ট।কিছু বল।"
"আর কি চাইবো?আর তো কিছু চাওয়ার নেই।এই একটা জিনিসের ই তো কমতি ছিল।তোদের মাঝখানে আমি বাধা হয়ে থাকবো না।ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করবো।জানি না তোর ভাগ্যে তুরিন আছে কি না?কিন্তু যে এই জীবন সঙ্গী হবে সে খুব ভাগ্যবান দোস্ত।কোনো দিন ওকে কষ্ট দিস না,আগলে রাখিস।আর দ্রুত সব ঠিক করে নে। তোর বউ নিয়ে পালালে আবার আমাকে দোষারোপ করতে পারবি না।"চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে যায়।তবুও হাসি মুখে শেষ বাক্যটা বলে।
ধ্রুব বন্ধুর কথা শুনে খুশি হয়।বন্ধুর চোখের পানি আর ব্যাথার্ত হৃদয়ের জন্য কষ্ট পায়।ওর চোখও পানি চলে আসে।চেয়ার ছেড়ে উঠে জিসানকে জড়িয়ে ধরে।ভেজা কন্ঠে বলো"থ্যাংক্স দোস্ত।জানিস না তুই আমাকে কি দিয়েছিস।ওকে ছাড়া আমি দিশেহারা।ডিরেক্ট পাগল হয়ে যাব দোস্ত।থ্যাংক্স দোস্ত,থ্যাংক্স এ্যালট।"
জিসান ও ধ্রুবকে জরিয়ে ধরে।আর বলে"এতো ফরমালিটি দেখাস না।পরে কিন্তু হিতে বিপরীত হবে।"
ধ্রুব আর জিসান এক সাথে হেসে উঠে।ধ্রুবর মাথা থেকে একটা বোঝা নামে।আজকে হয়তো নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারবে।
রাত ১০টায় হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরে।তুর ঘুমিয়ে থাকায়,ঘুমন্ত তুরকে কোলে আবারও কোলে তুলে নেয়।কোলে নিয়ে বুকের সাথে চেপে ধরে।সদর দরজা দিয়ে ঢুকে সিড়ি বেয়ে সবার সামনে দিয়ে,ওকে নিয়ে ওর রুমে যায় বিছানায় শুইয়ে দেয়।
বড়রা সবাই সোফায় বসে ছিলো।ধ্রুবর পেছন পেছন সবাই উপরে আসে।কবির সাহেব ভালো করে লক্ষ্য করছে ধ্রুবর অস্থিরতা,কেয়ারিং।আর মনে মনে মেয়ের জন্য এমন একটা কেয়ারিং ছেলে চাইছে।অনেকে আবার ভেতরে ভেতরে জ্বলে ও যাচ্ছে।অনেকে আবার এহেন কান্ডে অবাক ও হচ্ছে।
পর দিন সকালে
ঘুম ভাঙতেই মাথায় যন্ত্রণা হয়।চিনচিনে ব্যথা করে।আর ভারি ভারি অনুভব হয়।হাত দিয়ে ব্যান্ডেজের আবরণের অস্তিত্ব পায়।পাশে ওর মা ঘুমিয়ে আছে।পড়নে এখনো গতকালের জামাটাই।ঘাড়ে বুকে এখানে ওখানে রক্তের ছিটে ফোটা লেগে শুকিয়ে আছে।গতকালের কথা মনে হয়।
নিচ থেকে এসে এক আকাশ কষ্ট নিয়ে বারন্দার গ্রিলে ধরে বাহিরে তাকিয়ে আছে।অনেক ক্ষণ ধরে আটকে রাখা অশ্রু চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় পড়ছে।ভাবছে "রাগের চোটে তো বলে ফেলেছে।সত্যি কি জিসান কে বিয়ে করতে হবে।পারবে মানতে? ধ্রুব যদি পারে... তবে ওকে ও পারতে হবে।রাইসা আপুর মতো ভালো মেয়ের সাথে ই ওনাকে মানায়।কতো সুন্দর লাগছিল দু'জন কে পাশাপাশি।কেন এতো পারফেক্ট হলেন? আমি জানি আপনার মনটা ও আপনার মত অনেক সুন্দর।তাই তো আমার কপালে নেই।যাকে ভালোবাসবেন তাকে প্রচন্ড ভালোবাসবেন।রাইসা আপু অনেক লাকি।কপাল পোড়া শুধু আমার... ..."
এসব ভাবতে ভাবতে হঠাত মাথা চক্কর দিয়ে উঠে।চোখ মুখে শুধু আধার দেখতে পায়।কয়েক দিন ধরে অনিয়মিত খাওয়া,কান্নাকাটি,অতিরিক্ত টেনশন ,সারাদিনের ধকল সব মিলিয়ে সেন্সলেস হয়ে টবের সাথে বারি খেয়ে ফ্লোরে পড়ে।তার পর আর কিছু মনে নেই।শুধু একবার তাকিয়ে বুঝতে পেরেছে হাসপাতালে আছে।পাশে কেউ বলছে
"বাসি দোস্ত নিজের সবটুকু উজাড় করে দিয়ে ভালোবাসি।কিন্তু একটা.... ..... থেকে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি... ,যে আজও পর্যন্ত..... ..... করতে পারিনি।"
ঘড়িতে সবে মাত্র ৪টা বাজে।ড্রেসটা চেন্জ করতে হবে।উঠে দাড়ায় কাবার্ড থেকে জামা নিয়ে বাথরুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে বের হয়।চারিদিকে এখনো অন্ধকারে ছেয়ে আছে।রুমে দম বন্ধ লাগছে।মায়ের ঘুম যেন না ভাঙে তাই চুপিসারে রুম থেকে বের হয়।করিডোরের বারান্দায় দোলনায় গিয়ে বসে।এখানে এলে ওর মনটা ভালো হয়ে যায়।চারিদিকে শীতল স্নিগ্ধ মৃদু হাওয়া বইছে।মনের সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেছে।সব কষ্ট যেন হাওয়ায় উড়ে গেছে।হঠাত করে ধ্রুব কে খুব মনে পরছে।কালকে দুপুরের পর আর দেখা হয়নি।আচ্ছা আমি যে ব্যাথা পেয়েছি উনি কি জানে।আর জানলেই বা কি,উনি তো অন্য কারো ব্যাথায় ব্যাথা পাবে।
দোলনা ছেড়ে উঠে দাড়ায়...
কিছু দিন পর অন্য কারো হওয়া মানুষ টা কে চুপিসারে মন ভরে একটু দেখবে।পা টিপে টিপে স্লথ গতিতে ধ্রুবর রুমে প্রবেশ করে।দরজাটা চাপিয়ে দিয়ে ধীরে ধীরে সামনে এগোয়।দিনের আলো না ফোটায় এখনো রুমে আলো প্রবেশ করেনি।ডিম লাইটের মৃদু নিল আলো ছেয়ে আছে।পুরো রুমটা আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে।সেই মৃদু আলোতে বিছানার একটু দূর থেকে ধ্রুব মুখটা দেখছে।শরীরের অবয়ব টা অস্পষ্ট ভাবে দেখা যাচ্ছে।কেমন বাচ্চাদের মতো ইনোসেন্ট দেখাচ্ছে।ঘুমন্ত মুখটা থেকে যেন মায়া উপচে পড়ছে।
ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে ভাবছে"এই লোকটা ই কারণে অকারণে কতো রাগ দেখিয়েছে।রাগ দেখাতে গিয়ে ও কাছে এসে পড়েছে।আপনি কি জানেন ,নৌকায় সেই মাতাল স্বরের কবিতা আমাকে ও আপনার সাথে মাতাল করে দিয়েছিল।সেদিন রাতে ছাদে দেয়া চুমু ওটা ছিলো আপনার দেয়া প্রথম আদুরে স্পর্শ,আর আমার ভালোবাসার মানুষের প্রথম উপহার।আমার জীবনে প্রথম কোনো পুরুষের স্পর্শ। আপনার বার বার কাছে আসার চেষ্টা,ঘোর লাগানো চাহনি যে আপনার প্রতি আমাকে খুব বেশি দুবর্ল করে দিয়েছে।ক্ষণে ক্ষণে শরীরে কাঁপন তুলে দিয়েছে।এখন কিভাবে আপনাকে ছাড়া বাঁচবো?কিভাবে অন্য কারো সাথে দেখবো?অন্য কারো হতে দেখবো?আপনার এই সব পাগলামি কিভাবে ভুলবো বলতে পারেন..?"এসব বলতে বলতে চোখ বেয়ে ঝরঝর করে পানি পড়ছে।
ধ্রুবর বা হাত টা বিছানার বাহিরে ঝুলে আছে।ওর কষ্ট হচ্ছে ভেবে,তুর আর একটু কাছে গিয়ে দু হাতে ধ্রুবর হাতটা ধরে বুকের উপর রাখে।রাখার সাথে সাথে ধ্রুব ঘুমের ঘোরে খপ করে তুরের হাতটা চেপে ধরে।হেঁচকা টানে বিছানায় ফেলে দেয়।গলায় মুখ গুজে নরম শরীরটা জরিয়ে ধরে শুয়ে থাকে।আকস্মিক আক্রমণে তুর ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়।কি হয়েছে বুঝতে ২ মিনিট সময় লেগে যায়।খেয়াল হতে বুঝতে পারে ধ্রুব শুধু শর্টস পরনে খালি গায়ে,ওকে জড়িয়ে রেখেছে।এলোমেলো ভাবে বিছানায় পড়ায় জামার উপরি ভাগ উল্টে পিঠের দিকে আটকে গেছে।তাই পেটের অনেকটা জায়গা উন্মুক্ত হয়ে আছে।আর সেই উন্মুক্ত স্থানে ধ্রুব এক হাত দিয়ে চেপে ধরেছে।ওর শরীরের কাপাকাপি রোগটা ফিরে এসেছে।দাঁতে দাঁত বারি লাগছে।ঠোঁট কাপছে সারা শরীর থরথর করে কাপছে। সব শক্তি কোথায় যেন উবে গেছে।অবশ হয়ে গেছে পুরো শরীর।নিজেকে নড়ানোর জোরটুকু ও অবশিষ্ট নেই।
মনে মনে ভাবছে...
"ওমা গো... কেন এলাম গো...মরতে এখানে,এখন এই অসভ্য হাতিটার কাছ থেকে কিভাবে নিজেকে ছাড়াবো।"
মনে সাহস সঞ্চয় করে যেই ছুটার চেষ্টা করবে,,তখনই ঘুমের ঘোরে ধ্রুব বলে উঠে "উমমমম... জাননন... এমন করো না...ঘুমোতে দেওওওও..."
বলেই পেটে থাকা হাত আরো জোরে চেপে ধরে, গলায় আরো গভীর ভাবে নাক ডুবিয়ে দেয়।তুরের দমবন্ধ হয়ে যাচ্ছে।নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।নিজেকে শ্বাস কষ্টের রোগীর মতো মনে হচ্ছে।শরীরের সব শক্তি দিয়ে ও নড়তে পারছে না।এ দিকে মাথার কাটা জায়গাটায় পুনরায় ব্যাথা চাড়া দিয়ে উঠে।আর মুখ দিয়ে অস্পষ্ট ভাবে "আহ..."শব্দ বের হয়।
সাথে সাথে ধ্রুব চোখ মেলে তাকায়... ... ...
চলবে.......