হৃদয়ের নিকুঞ্জ নিড়ে- গল্পকন্যার ধারাবাহিক প্রেমের গল্প ( পর্ব-০৭ ) |
হৃদয়ের নিকুঞ্জ নিড়ে
পর্বঃ ০৭
রাত ৯.৪৫।
প্রতিদিনকার ন্যায় আজকে পাপড়ির মোবাইলে কোনো কল আসেনি।মোবাইল হাতে বসে আছে। দুপুর থেকে এখন পর্যন্ত কিছুই ভালো লাগছে না।নিজের বর্তমান পরিস্থিতি কি করে কাউকে বোঝাবে?তখনের কথা মনে হয়ে ওর খুব কান্না পাচ্ছে।
পনেরো মিনিট পেরিয়ে গেছে কিন্তু রাতের কল আসছে না।পাপড়ি আর কিছু না ভেবে রাতের নাম্বারে কল করে।
দুপুর থেকে রাতের মুড অফ।রীতিমতো প্রচন্ড মন খারাপ।ঐ বদমেজাজি সোহান যদি ওকে চড় মারতো ওর ততোটা খারাপ লাগতো না যতোটা না পাপড়ির চড় মারাতে লেগেছে,বিষয়টা মানতে পারছে না।
তবে একটা বিষয় ওর কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে যে,ওদের দুজনের সম্পর্কটা আর পাঁচটা সাভাবিক সম্পর্কের মতো না।আর যাই হোক এটাকে কোনোভাবেই ভালোবাসা বলা যায় না।
এ কথা ভাবতে-ই এতো এতো খারাপ লাগা অনুভূতির মধ্যেও ওর ভালো লাগছে।মনে বলছে,"এই বদমেজাজি সোহানের কাছ থেকে সরিয়ে নেয়ার একটা চেষ্টা তোকে করতেই হবে।"কিন্তু বিবেক তাতে সায় দিচ্ছে না।
ভাবনার মধ্যেই ফোন বেজে ওঠে।স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে সুহাসিনী নামটি।
মনের আকাশে বিশাল কালো মেঘে ছাওয়া থাকলেও দূরপ্রান্তের মানুষটির জন্য এক অমোঘ টান অনুভব হচ্ছে। সেই টানে স্থির থাকতে পারেনি।কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে রিসিভ করে নেয়।কিন্তু কোনো কথা বলে না।অপর পাশ থেকেও কোনো সাড়াশব্দ নেই।
কিয়ৎক্ষণ অতিবাহিত হতেই পাপড়ি তার সুমিষ্ট কন্ঠে বলে উঠে,"কথা বলবে না!"
রাত চুপ করে শুনছে।সারাদিন রাগ আর ভিষণ মন খারাপের মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত হলেও, এখন পাপড়ির যেচে কল করাতে সব উবে গেছে।তবু চুপ করে আছে।
পাপড়ি ফের আদুরে স্বরে বলে,"রাগ করে আছো আমার সাথে?"
এবার রাতের মধ্যেকার অভিমানের বহ্নিপ্রকাশ হয়,"করা উচিত নয় কি?"
" জানো তো!এ পৃথিবীতে সব কিছুর পেছনে একটা কারণ থাকে।আর সব কারণ কিন্তু খারাপ হয় না,ভালোর জন্য-ও হয়।"
"কি কারণই বা হতে পারে?হয়তো আমি চড় খাওয়ার উপযুক্ত তাই চড় খেলাম।"
"নাহ তুমি কোনো দোষ করোনি।দোষ তো আমার ভাগ্যের।আর তুমি সোহানকে চেনো না।ওর ভুল হোক কিংবা ঠিক,ও ওর মুখের উপর কথা বলা পছন্দ করে না।জুনিয়রদের থেকে তো না-ই।ওর ইগো হার্ট হয়।
এমন হলে ওর মাথা কাজ করে না।তখন যা খুশি করতে পারে। জানো...!এর থেকে আমি ও রেহাই পাইনি।একদিন আমাকেও....।যাইহোক আমি চাই না আমার জন্য তুমি ওর হাতে মার খাও।তাই আমি তোমাকে....ভুল হয়ে গেছে,ক্ষমা করে দিও প্লিজ।আর নেক্সট টাইম অন্য কোনো সম্পর্ক তো দূরে থাক, আমার কাছে কখনো বন্ধুত্তের সম্পর্ক নিয়ে ও এসো না।এর পরিণতি তোমার জন্য বিপজ্জনক হবে।"
রাত একটা চড়ের পেছনের কারণ জেনে অবাক হয়।সাথে সাথে এটা ভেবে প্রশান্তি হচ্ছে যে ওর কথা ভেবে পাপড়ি বিষন্ন,ওর বিপদের কথা ভেবে উদ্বিগ্ন,ওকে কষ্ট দিয়ে পাপড়ি নিজেই দুঃখীত।পাপড়ির যে অনুভূতি তাতে পরিষ্কার সোহানের থেকে রাতের প্রতি ওর মনটা একটু বেশিই দুর্বল।
দৃঢ়তার সঙ্গে রাত বলে,"যত যাই হোক, আমি তোমাকে ছাড়বো না।দরকার হলে সোহানের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেবো।ওর কোনো যোগ্যতা নেই তোমার মতো এমন কোমল মনের কারো অধিকারি হওয়ার।"
পাপড়ি রাতের কথা শুনে ফোনের সংযোগ বিছিন্ন করে।বুকে বালিশ চেপে ধরে।চোখের কোণ বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।"কেন আজকে ওর এই পরিণতি হবে?কেন ওর জীবনটা এমন দুঃখভরাক্রান্ত হবে?কেন আজকে নিজের জীবন বাজি রাখতে হচ্ছে নিজেরই জন্য ?"এসব ভাবতে ভাবতে কান্নায় ভেঙে পড়ে।এই বালিশ জড়িয়ে কান্না,বালিশে মুখ গুঁজে কান্না ওর রোজকার কাজ।তবে এ কান্না কেউ দেখে না।এমনকি ওর পাশে থাকা রুমমেটরা ও না।ঐ উপরওয়ালা ছাড়া কেউ জানে না ওর এই অনুভূতির কথা।
এভাবে কাঁদতে কাঁদতে কখন ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে টেরই পায় না।চোখ মেলে শুরু হয় আবারও ভালো থাকার অভিনয় করার একটা নতুন দিনের।
প্রতিদিনকার ন্যায় আজকেও রাত দাঁড়িয়ে থাকে পাপড়ির ডিপার্টমেন্টের রাস্তায়।ক্লাস শেষে সব স্টুডেন্টরা যে যার মতো ব্যস্ত হয়ে পরে।রাত দাঁড়িয়ে আছে পাপড়িকে দেখার আশায়।বেশ খানিক বাদে পাপড়ি বেরিয়ে আসে।রাতকে দেখে তার সভাবসুলভ মনোমুগ্ধকর হাসিতে হেসে উঠে।
যেদিন এই হাসিটা দেখতে না পায় সেদিনটাই রাতের কাছে বিষাদ ঠেকে।
রাত এগিয়ে যায় পাপড়ির দিকে।
"এই ছেলেটাকে দেখলে কেন #হৃদয়ের_নিকুঞ্জ_নিড়ে ঝড় উঠে?ভেতরটাকে উলোটপালোট করতে কোথা থেকে এর আগমন হয়েছে?কই সোহানের জন্য তো কখনো এমন অনুভূতি জাগেনি মনে?কতো সিনিয়র জুনিয়রই তো প্রোপোজাল দিয়েছে,কারো প্রতি কখনো এমন অনুভূতি হয়নি তো আগে?এ ছেলের চোখে কেমন অদ্ভুত মাদকতা আছে,তাকালে চোখ ফেরানো যায় না!দিন দিন কেমন মোহাবিষ্ট করে ফেলছে!একদিন কথা না হলে ভেতরে কেমন অস্থিরতা কাজ করে!সব কিছুই কেমন একঘেয়ে লাগে!"
রাতের দিকে তাকিয়ে পাপড়ি গভীর ভাবনায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে।রাত বলে,"কি ব্যপার কি হলো তোমার?"
ঘোর কাটতেই লজ্জা অনুভব করে,তাই সেটা এড়াতে বলে,"তোকে না নিষেধ করেছি আমাকে তুমি করে বলতে?সোহান শুনলে তোকে ধরে ঠ্যাঙাবে!"
"আমার ইচ্ছে আমি বলবো তাতে কার কি উল্টো হলো,আমার দেখার বিষয় নয়।"
"আমি নিষেধ করেছি। "
"ঠিক আছে প্রিয়!"
"কি বলছো...!" পাপড়ি বড়বড় তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠে।
"কিছু না,আপনি পড়াতে যাবেন তো!চলেন আমি এগিয়ে দিয়ে আসি।"
"তোমাকে না বারণ করেছি,আমার সাথে যোগাযোগ রাখতে?"
"কিন্তু সেটা সম্ভব নয়।"
পাশাপাশি হাটঁতে হাঁটতে পাপড়ি রাতের দিকে তাকায়,রাতকে পুরোদস্তুর দেখে,তারপর আনমনে ভাবে,"ছেলেটা না একটু বেশি-ই সুন্দর।গায়ের রঙ আমার চেয়েও ফর্সা,চোখের মনিগুলোও কেমন গভীর কালো, সুঠাম দেহের অধিকারী,লম্বা বেশ অনেকটাই ।পাশাপাশি দাঁড়ালে সোহানের থেকেও লম্বা দেখাবে।বেশ সুদর্শন-ও বলা চলে।হাঁটা আর কথা বলার ভঙ্গিমাতেও আছে নিপুণতা।ওভারস্মার্ট সাজতে চায় না।সেদিন সোহানের সাথে যেভাবে তর্ক করে উঠলো তাতে বোঝা যায় সৎসাহস-ও বিদ্যমান।এখনকার যুগের আর পাঁচটা ছেলের মতো ছটফটে চঞ্চল সভাবের নয়।শান্তসিষ্ট,ভদ্র টাইপের।
তবে মাঝে মধ্যেই ভিষণ দুষ্ট হয়ে যায়।"
ওর আরো একটা জিনিস পাপড়ির খুব ভালো লেগেছে। সেটা হলো,"ছেলেটা মিথ্যা বলে না,সত্যবাদি।আর যে সত্যবাদি,তার ভেতরের সত্ত্বা সুন্দর,পবিত্র।সেই তো হলো প্রকৃত সুন্দর। "অন্যমনষ্ক থাকায় পাপড়ি হঠাৎ-ই হোঁচট খেয়ে পড়ে যেতে নেয়।তাৎক্ষনাত রাত পাপড়ির ডান হাতের বাহুতে টেনে ধরে।যার ফলে খুব কাছাকাছি চলে আসে।পাপড়ি জীবনের প্রথম কোনো ছেলের এতো কাছে চলে এসেছে,শরীরে এক অদ্ভুত শিহরণ বয়ে গেছে।কয়েক সেকেন্ড আগের ঘটা ঘটনাতে পাপড়ির কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা।
রাত বলে," ঠিক আছেন আপনি?"
পাপড়ি নিজেকে ধাতস্থ করে বলে,"হ্যাঁ...! "
আবারও দুজনের যাত্রা শুরু হয়।জিরো পয়েন্টের কাছে চলে এসেছে।এটুকু সময় কারো মুখে কোনো কথা ফুটেনি।দুজনের মনেই দোলা দিয়ে যাচ্ছিলো কোনো অজানা সুখের।
এখন পাপড়ি একটা সিএনজিতে উঠে পড়বে ক্যাম্পসের বাইরে যাওয়ার জন্য।আর রাত চবি স্টেশনের দিকে যাবে শাটল ট্রেন ধরতে।
পাপড়ি ওর তখনকার শেষ না হওয়া কথাটা বলে,"রাত!"
রাত পাপড়ির চোখের দিকে তাকায়,"জি বলুন!"
পাপড়ি রাতের চোখের দিকে তাকাতেই রাতের চোখের গভীরতায় ডুবে যেতে থাকে,"অনেক ভালোবাসো?
গতকালের ঘটনার পর আজকে রাত আর চোখ নামায়নি।কেন যেন নামাতে ইচ্ছে করছে না।অবলীলায় বলে,"অনেক অনেক ভালোবাসি।"
একথা শুনে পাপড়ির মন ব্যথীত হয়ে উঠে ,"এ যে কোনোদিনো সম্ভব নয়।আমার ইচ্ছে কিংবা অনিচ্ছাতে আমি সোহানের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারবো না রাত।এ যে হওয়ার নয়।ভোলার চেষ্টা করো প্লিজ।না হয় কষ্ট পেতে হবে।"
রাতের ঠোঁটে স্মিত হাসি ফুটে,"আমি কষ্ট পাবো ভেবে কি আপনার মন ব্যথীত হয়?"
"হ্যাঁ হয়!ভিষণ ভাবে ব্যথীত হয়।"
রাত এবার চোখ সরিয়ে নেয়।চত্বরের দিকে তাকিয়ে বলে,"তাহলে জেনে রাখেন,আপনার মনে কখনো সোহান ভাইয়ের প্রতি ভালোবাসা জন্মায়-ই-নি,এতোদিন আপনার হৃদয় শূন্য ছিলো।আজ নতুন করে ভালোবাসার পরশ পেলো।প্রেমে পড়েছেন আপনি।সত্যিকার অর্থে প্রেমে পড়েছেন।"পাপড়ি রাতের কথা শুনে হেসে উঠে।
হঠাৎ একটা টয়োটা ল্যান্ড ক্রইজার এসে থামে ওদের পাশে। আকস্মিকতায় দু'জনে হতভম্ব।গাড়ির পেছনের দরজা খুলে স্যুটবুট পরিহিত মধ্য বয়স্ক একজন লোক বেরিয়ে আসে।দেখেই বোঝা যাচ্ছে সম্ভ্রান্ত কোনো ব্যক্তি।
পাপড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়।দাঁড়াতেই পাপড়ি রাতকে বলে,"রাত তুমি চলে যাও।"
রাত অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে থাকে।কারণ পাপড়ির আমূল পরিবর্তন।
রাত ভাবে,"এইতো হাসছিলো,আর এখন কোথাকার কোনো অচেনা মানুষ মনে হচ্ছে।"
লোকটা ওর হাতে ধরে গাড়িতে বসানোর জন্য। কিন্তু পাপড়ি ঝাড়া দিয়ে ছাড়িয়ে নেয়।অতঃপর রাতকে অবাক করে দিয়ে নিজেই গাড়িতে বসে পরে।পাশে সেই লোকটিও গিয়ে বসে।
তার পর পর-ই সামনের ড্রাইভিং সিটে বসা ড্রাইভার গাড়ি চালাতে শুরু করে।
রাত থ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।মনে পরে যায় বোটানিক্যাল গার্ডেনে তুলির বলা কথা গুলো.....
চলবে...