হৃদয়ের নিকুঞ্জ নিড়ে- গল্পকন্যার ধারাবাহিক প্রেমের গল্প ( পর্ব-০৮)

গল্প কন্যা (ছদ্ম নাম),প্রেম কাহিনী,হৃদয়ের নিকুঞ্জ নিড়ে,ধারাবাহিক,বাংলা গল্প,রোমান্টিক গল্প,romantik premer golpo,
হৃদয়ের নিকুঞ্জ নিড়ে- গল্পকন্যার ধারাবাহিক প্রেমের গল্প ( পর্ব-০৮)

হৃদয়ের নিকুঞ্জ নিড়ে
গল্পকন্যা


(আজকের পার্টের পর আর কোনো নতুন পার্ট আসবে না।)


৮.
দুদিন হলো পাপড়ির সাথে দেখা হয় না।ও নিজেও ব্যস্ত ছিলো কয়েকটা এসাইনমেন্টের জন্য।তবে সব কিছুর মধ্যেও বারবার পাপড়ির কথা মনে হচ্ছিল।কে সেই লোকটা জানতে খুব ইচ্ছে করছিলো।

তুলির কথা অনুযায়ী পাপড়ি আর ঐ লোকটার মধ্যে রাত তেমন অশালীন কোনো কিছু পায়নি।তুলি বলেছিলো মানুষের ধারণা পাপড়ি লোকটার সাথে এটিটিউট দেখায়,কারণ পাপড়ির অবৈধ সম্পর্ক।সেখানে ওর মনে হচ্ছে এই মধ্য বয়স্ক ব্যক্তির উপর পাপড়ির যেন ভিষণ ক্ষোভ।আর-ও একটা জিনিস লক্ষণীয়,সেটা হলো দুজনের চেহেরার কোথাও মিল আছে,কিন্তু মিলটা কোথায়,সেটা রাত ধরতে পারছে না।

এই দুদিন দু'জনের কেউ কাউকে ফোন করেনি।যদিও রাতের অনেক কষ্ট হয়েছে।কিন্তু রাত হঠাৎ হঠাৎ পাপড়ির পরিবর্তনের জন্য কিছুটা আহত।তাই যেচে ফোন করেনি।

সেই লোকটার সাথে দেখা হলে পাপড়ির মন মেজাজ বিক্ষিপ্ত থাকে।কারো সাথে তেমন কথা বলতে ইচ্ছে করে না।চুপচাপ শুয়ে থাকে।রুম ফাঁকা পেলে মাঝে মধ্যে বালিশ চেপে ধরে চোখের জল বিসর্জন দেয়।

অনেক দিন পর স্টুডেন্টদের গার্ডিয়ানের কাছ থেকে দুইদিনের ছুটি নিয়েছে ।আজকেও পাপড়ির যেতে ইচ্ছে করছে না।কিন্তু আজকে কামাই দিলে স্টুডেন্ট গুলো হাত ছাড়া হয়ে যাবে।

সকাল থেকে খালি পেটে।পেটের ভিতর গুরগুর শব্দ হচ্ছে।এখন কিছু না খেলে পেটের শোচনীয় অবস্থা হবে।

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখে আড়াইটা বেজে গেছে।এখন আর হলের ক্যান্টিন থেকে দুপুরের মিল পাওয়া যাবে না।ঝুপড়ি থেকেই খাবারটা খেতে হবে।দ্রুত তৈরী হয়ে বেরিয়ে পড়ে ঝুপড়ির উদ্দেশ্য।

রাত,জাহিদ,সুমন,কায়সার সবাই একসাথে আড্ডা দিচ্ছে ঝুপড়িতে।মূলত স্টুডেন্টদের জন্য এখানে ত্রিশ টাকায় খিচুড়ি পাওয়া যায়।যার টেস্ট অসাধারণ।সবাই মিলে গোগ্রাসে সেখানকার খিচুরি খেয়েছে।সবাই টেবিলে বসে আড্ডা দিচ্ছে।

রাত দোকানীর কাছে বিল পরিশোধ করতে গিয়েছে,বিল দিয়ে ঘুরতেই দেখে পাপড়ি।দু'জনে একেবারে মুখোমুখি।

এমন আকস্মিকতায় দু'জনেই হকচকিয়ে যায়।রাত জিজ্ঞেস করে, "কেমন আছেন?"

"ভালোই তো দেখতে পাচ্ছো!"কথাটায় একধরনের হেয়ালি ছিলো।রাতের মনে একদম খোঁচা দিয়ে গেছে।

তবু চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে পাপড়ির পাশে।পাপড়ি না দেখার মতো করে দোকানীকে বলে,"মামা আমাকে এক প্লেট খিচুড়ি দিন তো!"

ফাঁকা দেখে একটা চেয়ারে বসে পড়ে।পাপড়ির ভাবখানা এমন যেন রাত অপরিচিত কেউ।

রাত সেদিকে একিভাবে চেয়ে থাকে,দেখতে থাকে কিভাবে ওকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে।এর কোনো যথাযথ কারণ রাত খুঁজে পাচ্ছে না।কোথায় ওর রাগ করার কথা,সেখানে হচ্ছে উল্টোটা।

পাপড়ির সামনে খাবার দেয়া মাত্র,পাপড়ি মনোযোগ সহকারে খেতে শুরু করেছে।খাবার যখন প্রায় শেষের দিকে রাত ওর পাশের ফাঁকা চেয়ারে বসে পড়ে।কিছুটা রাগান্তিত স্বরে প্রশ্ন করে,"আমাকে এভোয়েট করছো?"

" না!"

"তো এমন করছো কেন?"

পাপড়ি চুপ করে প্লেটের বাকি খাবার টুকু মুখে পুড়ে নেয়।

"কি হলো,সেদিনের পর না তোমার কোনো ফোনকল,না ভার্সিটিতে এসে কোনো ক্লাস করছো,তোমার কোনো পাত্তাই নেই।কে ঐ লোকটা? যার সাথে দেখা হওয়ার পর একবারো আমার সাথে কথা বলতে পারলে না।"

এতোক্ষণে পাপড়ি ভ্রুকুঞ্চিত করে চায় রাতের দিকে,তারপর কিছুটা জোর গলায় বলে,"কে রে তুই!তোকে কেন আমি কৈফিয়ত দিতে যাবো!"

আসপাশে কিছু সংখ্যক মানুষ যারা ছিলো এভাবে পাপড়ির চিল্লানোতে,সবাই অদ্ভুত ভাবে রাতের দিকে চেয়ে আছে,এর মধ্যে রাতের বন্ধুরাও অবাক।

রাত ব্যথিত মনে প্রশ্নে করে,"আমি তোমার কেউ না?"

পাপড়ি একিভাবে জবাব দেয়,"না, তুই আমার কেউ না।আর তখন থেকে আমাকে কেন তুমি তুমি করে বলছিস হ্যাঁ।সিনিয়রদের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় জানিস না?"

"সরি ভুল হয়ে গেছে।আর হবে না।কিন্তু সেই লোকটা কে?উনার সাথে দেখা করার পর আপনার বিহেভিয়ার কেমন চেঞ্জ হয়ে গেছে ?

এ কথা শুনে রেগে পাপড়ি দাঁড়িয়ে যায়,চিল্লাতে চিল্লাতে বলে," তুই আমাকে সন্দেহ করছিস তাই না!আর সবার মতো আমাকে প্রস্টিটিউট ভাবছিস?টাকার বিনিময়ে...."

রাত অবাক হয়ে যায়,"না আমি তাই বলিনি,আপনি ভুল বুঝছেন!"

পাপড়ির চোখ বেয়ে ফোটা ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে।পাপড়ি কাঁদতে কাঁদতে বলে,"তাহলে সেদিনের পর একবারো তোর ফোন এলো না কেন?যেখানে তুই একদিন কথা না বলে থাকতে পারিস না!"

রাতের মুখে কথা ফুটছে না।কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না।"পাপড়ির রাগের কারণ তাহলে এটা,পাপড়ি তাহলে আমাকে ভুল বুঝে আছে।আসলেই তো ওর ফোন করা উচিত ছিলো।কিন্তু কারণ তো এটা ছিলো না।"

পাপড়ি আর এক সেকেন্ড ও দাঁড়ায়নি।দোকানীর টাকা পরিশোধ করে পা বাড়ায় চলে যাওয়ার জন্য।চোখ বেয়ে অনবরত পানি পড়েই যাচ্ছে।দ্রুত গতিতে পা ফেলে ঝুপড়ি থেকে কিছুটা দূরে রাস্তায় চলে যায়।

রাত পাপড়ির চলে যাওয়া দেখে দৌড়ে গিয়ে পাপড়ির হাত আকড়ে ধরে।"প্লিজ একটি বার শোনেন আমার কথা।আপনি আমাকে ভুল বুজছেন।রাগ করবেন না,মাথা ঠান্ডা করেন শোনেন প্লিজ।আমি কখনোই আপনাকে অমন ভাবি না।দুনিয়ার সব মানুষ আপনাকে অমন ভাবলেও আমি ভাবি না।আপনি আমার কাছে একটি পবিত্র সত্তা।আমি আপনাকে..."বাকি কথা শেষ করার আগে কারো সজোরে ধ্বাক্কায় ছিটকে পড়ে ইট কংকর পড়া রাস্তায়।কিছু বুঝে উঠার আগেই একের পর এক লাথি পড়ছে বুকে পেটে।

রাত যখন পাপড়ির হাতে ধরে কথা বলেছিলো,পাপড়ি-ও তখন নিচের দিকে তাকিয়ে নিজের জীবনের পরিনতির কথা ভেবে অন্যমনস্ক হয়ে কাঁদছিল।

দূর থেকে সোহানের চোখে পড়ে এ দৃশ্য। দৌড়ে এসে রাতকে ধ্বাক্কা দিয়ে ফেলে রাস্তায়, আর তারপর একের পর এক লাথি মারতে থাকে বুকে পেটে।আর মুখ দিয়ে নিসৃত হয় অকথ্য গালিগালাজ।"মা***দ তুই কোন সাহসে আমার জিএফের হাত ধরছিস! তোকে না নিষেধ করছি ওর আসপাশে থাকতে..."

পাপড়ি হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে এ পরিস্থিতি দেখে।সোহানকে ছাড়ানোর জন্য টানতে থাকে।যার ফলে হাত ঝাড়া দিয়ে পাপড়িকে সরিয়ে দেয়।পাপড়ি পড়ে যেতে যেতে দাঁড়িয়ে যায়।

রাতের বন্ধুরা রাতের আর্তনাদের শব্দ পেয়ে ঝুপড়ি থেকে দৌড়ে আসে।

ততক্ষণে পাপড়ি সোহানের পা আঁকড়ে ধরে শক্ত করে।কাঁদতে কাঁদতে বলে,"ওকে মেরো না প্লিজ ছেড়ে দেও ওর কোন দোষ নেই..."সোহান থেমে যায়।পাপড়ির হাত শক্ত করে ধরে টেনে নিয়ে যায় ওর সাথে।

রাতের বন্ধুরা এসে দেখে পাপড়ি সোহানের পায়ে ধরে আছে,তারা রাতের কাছে এসে রাতকে ধরে তুলে,এরমধ্যে সোহান পাপড়িকে নিয়ে চলে গেছে।

জাহিদ রেগে বলে,"মা***দ, ওরে আমি বড়ো ভাই মানি না।কু**চ্চারে সুযোগ পাইলে মাইরা ফেলবো।"রাতের হাজার বারণ স্বত্তে-ও ওকে নিয়ে চবি ক্যাম্পাসের হাসপাতালে যায়।পেট ও বুকের কয়েক জায়গায় নীলচে হয়ে গেছে।তাছাড়া কোথাও কিছু হয়নি।

রাতের মনের অবস্থা প্রকাশ করার মতো না।চাইলেই সোহানকে ধরে পেটাতে পারতো।সোহানের মতো স্থুলকায় দেহের মানুষকে কাবু করা ওর কাছে কোনো ব্যপার না।কিন্তু প্রসংঙ্গ হচ্ছে পাপড়ির,পাপড়ির বয়ফ্রেন্ড ও।

সুমন বলে,"শা* তুই ডাকলি না কেন আমাদের, বোঝাতাম ওরে, দেখাতাম ভাইগিরী।"

রাত নিশ্চুপ বন্ধুরা জোর করে একটা পেইনকিলার মুখে পুরে দেয়।

কায়সার বলে,"দোস্ত এ মেয়ের পিছু ছেড়ে দে,নয়তো তোর ক্ষতি হবে।আর আঙ্কেল আন্টি শুনলে কি হবে ভাবতো!"

রাত বলে,"সম্ভব না।তোদের আজকে বললাম মিলিয়ে নিস, পাপড়ি আমার হবে।আমার হওয়ার জন্য ও চোখের পানি ফেলবে।"


——————————


দু তিনদিন হল রাত পাপড়ির ডিপার্টমেন্টের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে না।পাপড়ির কোথাও একটা খুব জ্বালা অনুভব হয়।কিন্তু নিজের সাথে আর ওকে জড়াতে চায় না।আর কখনো ওর এমন পরিণতি দেখতে পারবে না।

পাপড়ি পড়াতে যাওয়ার সময় এখন।আজ আর দুপুরে খাওয়া হবে না।এম্নিতেও হলের পাতলা ডাল আর লবণ হলুদে সেদ্ধ করা বয়লার মুরগীর ঝোল ওর গলা দিয়ে নামে না।না খেয়ে থাকতে থাকতে ওর অভ্যাস হয়ে গেছে।

হাঁটতে হাঁটতে পাপড়ি একটা সিএনজি পেয়ে গেছে।উঠে দেখে ভেতরে জাহিদ।দেখে সভাবসুলভ মুচকি হেসে বলে,"কেমন আছো?"

জাহিদ-ও তদ্রুপ উত্তর করে।পাপড়ি জিজ্ঞেস করে,"বাসায় যাচ্ছো?"

"নাহ,রাতকে দেখতে যাচ্ছি।ওর অনেক জ্বর।সিএমএইচে ভর্তি আছে।"

পাপড়ির বুকের ভিতর কেউ মনে হচ্ছে খাঁমাচে ধরেছে।জল ছলছল চোখে বলে,"কি বলছো!"

"হ্যাঁ,আপনার বয়ফ্রেন্ড সেদিন যখন ওকে মেরেছে,তখন ওর বুকের পাঁজরের একটা হারে ইফেক্ট পড়েছে,একটা হার বাঁকা হয়ে গেছে।পেটে বুকে ছোপ ছোপ কালচে নীল দাগ হয়ে গেছে।সেদিন রাত থেকেই প্রচুর জ্বর আসে।মধ্য রাতেই হসপিটালাইজড করতে হয়েছে।তারপর বিভিন্ন টেস্টের মাধ্যমে জানা যায় এ তথ্য।শুধুমাত্র আপনার বয়ফ্রেন্ড দেখে ঐ শালা বেঁচে গেছে,নয়তো রাতের শরীরে-ও একজন মেলিট্রির রক্ত বইছে।একটা কথা বলি আপু এই সোহান ছেলেটা ভালো না, নানান খারাপ কাজে যুক্ত,এখনো সময় আছে ওকে ভুলে যান।আমাদের রাত খুব ভালো ছেলে।ওকে যে পাবে সে অনেক ভাগ্যবান হবে।"

সিএনজি থেমে গেছে কিন্তু পাপড়ি দু-হাতে মুখ ঢেকে কাঁদছে।ড্রাইবার বলছে,"আপা নামেন।"

পাপড়ি ধরফরিয়ে নামে,ড্রাইবারকে টাকা দেয়।তারপর জাহিদের পেছনে দৌড়ে যায়।জাহিদ বলে,"কিছু বলবেন?ভুল হলে ক্ষমা করে দিয়েন,আমার কলিজার বন্ধুর গায়ে হাত দিছে তাই বলে এতো কথা ফেললাম।"

"আমাকে নিয়ে যাও প্লিজ।প্লিজ ভাই নিয়ে যাও।" পাপড়ি কান্না ভেজা কন্ঠে অনুরোধ করে জাহিদকে।

জাহিদ অবাক হয়ে গেছে পাপড়ির কান্না দেখে।

"তাহলে কি রাতের কথা.... "


জাহিদ রাজি হয়েছে।পাপড়িকে সাথে নিয়েই যায় রাতের কাছে....




চলবে......