হৃদয়ের নিকুঞ্জ নিড়ে- গল্পকন্যার ধারাবাহিক প্রেমের গল্প ( পর্ব-১০ ) |
হৃদয়ের নিকুঞ্জ নিড়েপর্বঃ ১০গল্পকন্যা
পাপড়ি তাৎক্ষণিক সোহানকে ধাক্কা মেরে দৌড় লাগায়।
সোহান ভারসাম্য রক্ষা করতে না পেরে পড়ে যায়।পাপড়ির এহেন কান্ডে সোহান প্রচন্ড ক্ষুব্ধ হয়ে যায়।কোনো রকম উঠে দৌড়ে পাপড়ির পিছু নেয় ।আজকে যে করেই হোক কিস করবেই।ওর বন্ধুদের সঙ্গে বাজি ধরেছে।
ওরা আড়াল থেকে ফোনে ভিডিও অন করে রেখেছে।এই ভিডিও দিয়ে-ই পাপড়িকে ব্ল্যাকমেইল করে ইন্টিমেন্ট হবে।তাছাড়া উপায় নেই।কিন্তু মেয়েটা অনেক চালাক।সোহান দৌড়ে পাপড়িকে ধরে ফেলে।
পাপড়ি তাকিয়ে দেখে আসেপাশে কেউ নেই।হাত ছাড়ানোর প্রাণপণ চেষ্টা করছে।বারবার-ই ব্যর্থ হচ্ছে।হঠাৎ বাইকের শব্দ হয়।সোহান চট করে পাপড়ির হাত ছেড়ে দিয়ে ভদ্র সেজে দাঁড়ায়।
পাপড়ি বাইক চালক কে দেখার জন্য ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়।
তিনটা বাইকে চড়ে জাহিদ,সুমন,আফসার,কায়সার,রাত,বড় ভাই রিয়াদ এসেছে।
রিয়াদ সোহান একি ব্যাচের।একে অপরের সাথে পরিচিত ও বলা যেতে পারে।বাইকের পেছনে বসে পাপড়িকে দেখে বলে,"কি রে এখানে...?আজকে পড়াতে যাবি না।তোর স্টুডেন্টের মা তো অন্বেষণে বসবে।"
পাপড়ি ভয়ার্ত স্বরে বলে,"যাচ্ছি ভাইয়া।"
বাইক থামিয়ে সবাই নামে।সোহান খানিকটা দূরে বসে থাকা ওর বন্ধুদের কাছে চলে যায়।
রাত পাপড়ির দিকে তাকিয়ে ঈশারায় জিজ্ঞেস করে,"কিছু হয়েছে কি?"
পাপড়ির মনে পড়ে যায় বারবার রাতের নিষেধাজ্ঞার কথা।চোখ জোড়া জলে ভরে উঠে।মাথা নাড়িয়ে বোঝায় সব ঠিক আছে।কৃতজ্ঞতাপূর্ণ হাসি হেসে পা বাড়ায়।
—————————
সারি সারি সবুজ ঝাউবীথি, পাহাড়, ঝর্ণা, আর নরম বালির মাঝে দীর্ঘ অপরূপ সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার। সাগরের নীল জলরাশি আর ঢেউয়ের গর্জনের সাথে হিমেল হাওয়ায় মনোমুগ্ধকর এক পরিবেশ। নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ভরা পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার। সৃষ্টিকর্তা যেন রূপসী বাংলার সব রূপ ঢেলে দিয়েছে বালুর আঁচলে।
১২০ কিলোমিটারের দীর্ঘ দর্শনীয় সমুদ্র সৈকতের কারণে প্রতি বছর দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভ্রমণপিয়াসী পর্যটক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি কক্সবাজারে ঘুরতে আসে। নাজিরার টেক থেকে শুরু করে শাহপরীর দ্বীপ পর্যন্ত বিস্তৃত সৈকতের বেলাভূমি।
সুদীর্ঘ সমুদ্র সৈকত, দিগন্ত বিস্তৃত নীল সমুদ্র, বড় পাহাড়, প্যাগোডাসহ নানান আকর্ষণ নিয়ে গড়া পর্যটন রাজধানী কক্সবাজারে পা রাখলেই সাগরতীরে বেড়াতে মন চায়।বিভিন্ন মৌসুমে সাগরের লোনা জলে দেখা যায় বিভিন্ন রূপ।সমুদ্রের জলে স্নান আর সূর্যাস্তের নয়নাভিরাম দৃশ্য অবলোকনসহ শরীরের প্রশান্তি জুড়ায়। ভোরের স্নিগ্ধ আলোয় সমুদ্র সৈকতের ভিন্ন রূপ আর সন্ধ্যার পরে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে। বিশেষ করে পূর্ণিমার রাতে আকাশের উজ্জ্বল চাঁদ সমুদ্রের জলে প্রতিফলনের দৃশ্য আনন্দের মাত্রাকে বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়।
স্বচ্ছ নীল জলরাশির বিশাল সমুদ্র সৈকত। প্রকৃতি আর সময়ের এত আয়োজন একসঙ্গে উপভোগের সুযোগকে হাতছাড়া করতে চায়নি পাপড়ি। তাইতো সকলের সাথে ছুটে এসেছে কক্সবাজারে।ভোর বেলা রওনা হয়েছে,প্রায় এক দের ঘন্টার জার্নির পর কক্সবাজারে এসে পৌঁছেছে।পথিমধ্যে চমৎকার প্রাকৃতিক সবুজ মনোরম পরিবেশ পুরো জার্নিটাই খুব উপভোগ করেছে।
বাস থেকে নেমে সবাই সবার জিনিস পত্র নিয়ে যার যার বরাদ্দকৃত রুমে চলে যায়।নিজের জায়গা বুঝে জিনিস পত্র রেখে বেরিয়ে পরে নাস্তার উদ্দেশ্যে।
অফহোয়াইট প্যান্ট,হাটু অব্দি হোয়াইট টপস,গলায় পিংক ওড়না পেঁচানো।পুরো দস্তুর টুরিস্ট লুকে রুম থেকে বেরোয় পাপড়ি।
ক্যাম্পাসের সিনিয়র জুনিয়র অনেকের-ই ক্রাশ পাপড়ি।কিন্তু সোহানের জন্য এগোতে পারে না।এখন যেহেতু সাথে সোহান নেই।তাই সবাই কম বেশি সুযোগ পেয়েছে।
নাস্তা শেষ করতে করতে আটটা বেজে গেছে।সবাই সমুদ্র দর্শনে বেরিয়ে পড়ে।
পুরো জার্নিতে রাত বন্ধুদের সাথে ছিলো,নাম্তা সেরে বন্ধুদের সাথে বেরিয়ে পরে।নাস্তা করতে গিয়ে এর মধ্যে পাপড়ির সাথে বেশ কয়েক বার দৃষ্টি বিনিময় হয়েছে।প্রথম দর্শনে তো রাত হা করে তাকিয়ে ছিলো।
রাতের বারবার মনে হচ্ছে,"ইসস মেয়েটা যদি আমার বউ হতো..."তারপর নিজের অবাঞ্ছিত ভাবনায় নিজে-ই হেসে উঠেছে।
সবাই সবার মতো করে ঘুরছে।অনেকে আবার স্যারদের কাছ থেকে পারমিশন নিয়ে নিজেরা নিজেরাই আসেপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
পাপড়ি আর ওর বান্ধবীরা ও স্যারের কাছ থেকে পারমিশন নিয়ে সমুদ্রে গোসলের উদ্দেশ্যে যায়।স্যার অনুমতি দেয় এবং বারোটার মধ্যে হোটেলে ফিরে যেতে বলে।
অনেকে আবার স্যারদের গাইড লাইন অনুযায়ী তাদের সাথে থেকে ঘুরছে।কিন্তু স্যারদের সামনে তো আর যেভাবে ইচ্ছে ঘুরাফেরা করা যায় না।
রাত কক্সবাজারে অনেক বার এসেছে।
সুগন্ধ্যা বিচ,বার্মিজ মার্কেট, হিলটপ রেস্টহাউস, লাবনী পয়েন্ট, পাহাড় ঝর্ণা হিমছড়ী, পাথুরে সৈকত ইনানী, নাইক্ষ্যংছড়ী লেক ও ঝুলন্ত ব্রিজ, রাবার বাগান, ডুলাহাজরা সাফারি পার্ক, কলাতলী বীচ, লং মেরিন ড্রাইভ, রেডিয়েন্ট ফিশ অ্যাকুয়ারিয়াম, দরিযানগর, নয়নাভিরাম প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন, পাহাড়ি দ্বীপ মহেশখালী, সোনাদিয়া দ্বীপ, ইতিহাসখ্যাত কানারাজার গুহা, রাখাইন পলস্নী মোটামুটি সব জায়গায় ঘুরেছে।তার মধ্যে লং মেরিন ড্রাইভ ওর বেশি ভালো লেগেছে।
জাহিদ বিচে এসে-ই ইফতিকে নিয়ে নিজের মতো ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।সুমন,কায়সার ওরা ও এক একটা ফ্লার্টিং করা শুরু করে দিয়েছে।রাত এদের কান্ড দেখে হতো বিহ্বল।এদের সাথে থেকে কাজ নেই,তাহলে ওর ঘুরাঘুরি নষ্ট হবে।
সামনে-ই চোখে পড়ে পাপড়িকে।সাথে আর কয়েকজন সিনিয়র আপু।
রাত একাকী হাঁটছে।দেখে এক জায়গায় ওয়াটার মোটরবাইক রাখা।রাত সেখানে যেয়ে একটা লোকের কাছ থেকে এক ঘন্টার জন্য মোটরবাইকভাড়া নেয়।তারপর উৎফুল্লতার সাথে রাইডিং করতে থাকে আর ভিজতে থাকে।
এদিকে পাপড়ি ও সাথের মেয়েগুলো সব পানিতে ঝাঁপাঝাপি করছে।সমুদ্রের পানিতে নামা পাপড়ির কাছে সেরা অনুভূতি।ছোটো বেলায় বিচে এসে পানিতে নামার জন্য অনেক চেষ্টা করেছে।বিচে এলেও পানিতে নামতে দেইনি কেউ।
রাতের খুব ইচ্ছে করছে পাপড়িকে সামনে বসিয়ে রাইডিং করতে।মনে মনে ভাবে,"হবে রাত হবে,বিয়ের পর হবে,ধৈর্য্য ধর পাগলা।"পাপড়িরা যেখানে গোসল করছে,পাশ দিয়ে রাত একটা রাউন্ড দিয়ে যায়।যার ফলে কিছু পানি ছিটকে মেয়েদের উপরে আসে।
হাঁটু অব্দি থ্রি কোয়াটার প্যান্ট,ফর্সা গায়ে কালো টি-শার্ট,তার উপরে লাইফ জ্যাকেট চাপিয়ে রাত মোটরবাইক চালাচ্ছে।মোটরবাইকের দুপাশে পানি ছিটকে এসে রাতকে ভিজিয়ে দিচ্ছে।
যা দেখে মেয়ে গুলো সব চিল্লাতে থাকে।চিল্লাতে চিল্লাতে বলে ওরাও উঠতে চায়।কিন্তু ওরা একা উঠতে পারবে না।মেয়েদের মধ্যে একজন রাতকে ডাকে।রাত ওদের কাছে আসে,"জি আপু!"
"আমরা ও উঠবো,প্লিজ হেল্প করো।"
"কিভাবে হেল্প করবো?"
"তোমার সাথে এক এক করে উঠাও আমাদের!"
এটা শুনে পাপড়ির ভেতর কেমন ঈর্সা অনুভব হয়।
পাপড়ি কিছু বললো না হাটু অব্দি পানিতে দাঁড়িয়ে আছে।সাদা রঙের জামাটি ভিজে শরীরের সাথে লেপ্টে আছে।ভেতরের অন্তর্বাস দৃশ্যমান।তাই ওড়না পেঁচিয়ে রেখেছে।বাকি মেয়ে গুলোর মধ্যে লাজলজ্জার বালাই নেই।
রাত ওদের দেখে মনে মনে কয়েকটা ভদ্র গালি দেয়।তারপর বলে,"ঠিক আছে,আপনাদের সবাইকে তো আমি একা উঠাতে পারবো না।কিন্তু একটা উপায় বের করা যাবে।"
সবাই বলে,"কি বলো।"
"আপনারা পাঁচজন আছেন,আপনাদের নাম আমি আমার পাঁচ আঙুলে ধরবো,যার নাম উঠবে সে সিলেক্ট হবেন,তাকে আমার সাথে উঠাবো।"
সবাই রাজি।রাত সবার নাম জেনে ডান হাত বাড়ালো।
"রেডি..."
মুহূর্তের মধ্যে সবাই হামলে পড়ে রাতের আঙুলে,শুধু পাপড়ি ছাড়া।রাতের চার আঙুলে চারজন ধরেছে,বৃদ্ধাঙ্গুলি এখনো ধরা বাকি।
রাতের দিকে সবাই তাকিয়ে আছে কারটা সঠিক হয়েছে জানার জন্য।
রাত সবার উদ্দেশ্যে বলে," এখনো তো একজন বাকি।তাহলে কিভাবে হবে বলুন?"সবাই পাপড়ির উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে উঠে।পাপড়ি না পেরে আঙুলে ধরে।
এবার রাত বলে,"আপনাদের মধ্যে পাপড়ি নাম সিলেক্ট হয়েছে।"
সবাই মন খারাপ করে ফেলে।রাত বলে,"মন খারাপ করবেন না।আপনারা চারজন বিচ ধরে একটু সামনে যান,দেখেবেন অনেক লোক বসে আছে।বিশ মিনিট,ত্রিশ মিনিট,এক ঘন্টা যতক্ষণ ইচ্ছে উনারা নিজ দ্বায়িত্ব্যে ঘুরাবে।"
কথাটা শোনা মাত্র সব গুলো ছোটা শুরু করে দিয়েছে।রাত পাপড়িকে বলে,"উঠো!"
পাপড়ি বড়োবড়ো করে তাকায়।রাত বলে,"বাবা রে ভয় পাইছি,উঠেন মহারানী।আমার সাথে না উঠলে,আপনার বান্ধবীদের মতো ঐ অচেনা লোক গুলোর সাথে উঠতে হবে।তারা কিন্তু সবাই আমার মতো ভালো না।"
পাপড়ি মুচকি হেসে রাতের দিকে তাকিয়ে থাকে।তাই দেখে রাত বলে,"জানেন তো এই কক্সবাজারে এসে যে ওয়াটার মোটরবাইকে না উঠে,তার ভ্রমণটাই বৃথা।"
পাপড়ি কোমড়ের দু'পাশে হাত রেখে বলে,"তাই।"
রাত মাথা নাড়িয়ে অবুঝ বালকের মতো উত্তর দেয়,"হ্যাঁ তো...।আসেন আসেন।সামনে বসবেন,নাকি পেছনে?"
পাপড়ি রাতের ডান হাতে ভর করে পেছনে উঠে বসে।রাত ভেতরে ভেতর প্রচন্ড খুশি।খুশিতে লাফাতে ইচ্ছে করছে।
রাত ওর মোটরবাইক চালানো শুরু করবে তাই পাপড়িকে বলে,"বসেছেন তো ঠিক করে।"
"হ্যাঁ।"
"কই,স্টার্ট দিলেই তো পড়ে যাবেন।আমাকে ভালো করে ধরেন।"
এই ভেজা শরীরে রাতের সাথে বসতেই গা কাঁপুনি উঠছে,তার মধ্যে কিভাবে ধরবে।কাঁপা কাঁপা হাতে রাতের কাঁধে হাত রাখে।
রাত বলে,"পেটে জড়িয়ে ধরেন।"
পাপড়ি ধুম করে রাতের পিঠে কিল মেরে বসে।রাত আউচ করে উঠে হেঁসে দেয়।তারপর স্পিড বাড়িয়ে স্টার্ট করে।
পাপড়ি হুমড়ি খেয়ে রাতের পিঠের উপর পড়ে।ভয়ে চিৎকার করে রাতকে ঝাপটে ধরে।রাত হোহো করে হেসে উঠে।তার পরের পাঁচ মিনিট কেটে যায় ভয় কাটাতে কাটাতে।
রাত বলে,"দূর বোকা ভয় পাচ্ছো কেন,আমি আছি তো, শক্ত করে ধরে রাখো।"পাপড়ি শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাতকে।
এভাবে মিনিট দশেক যাওয়ার পর পাপড়ির ভালো লাগতে শুরু করে।নিজ থেকেই বলে,"রাত...!ভিষণ ভালো লাগছে।থ্যাংক ইউ সো মাচ।"
"ওয়েলকাম সুহাসিনী।যদি সত্যিই ভালো লাগে,তাহলে আমাকে একটা উপহার দিতে হবে।"
"আচ্ছা তাই!"
"জি।"
"কি উপহার চাও?"
"আজকে বিকেলটা আমাকে দিতে হবে।আমার সাথে মেরিন ড্রাইভে যেতে হবে।কারণ রাত সুহাসিনীকে আর-ও একটি সুন্দর অনুভূতি দিতে চলেছে।"
"সত্যি বলছো!"
"ইয়েস,প্রিন্সেস।"
"ঠিক আছে।যাবো।"
ত্রিশ মিনিট পাপড়িকে নিয়ে ঘুরে যখন তীরে এসে নামবে।রাত পেছনের দিকে হালকা ঘুরে বলে,"নেক্সট টাইম এমন ড্রেস পরে পানিতে নামবে না।"
রাত কি বোঝাতে চাচ্ছে তা পাপড়ির বোধগম্য। লজ্জায় চোখ কোটর থেকে বের হয়ে যাওয়ার উপক্রম।
চলবে....