মনে আছে তোর , আমাদের বাড়িতে একটা দড়ির দোলনা ছিলো। তোকে ওটাতে বসতে দিতে চাইলো না , সেদিন নতুন কাকিমা মানে ছোটো কাকিমা। তুই কেন, আমাকেও বসতে দিতে চাইছিলো না। পুচুকটার জন্য সাবধানে থাকতে হয়েছিল বোধহয়। অসুখ হবে তাই। আসলে আমরা পাড়া গাঁয়ের মানুষেরা সবাই সবার জিনিস, সবাই ব্যবহার করি। কাকিমার সেটা ভালো লাগতো না।
তোকে বটের ঝুড়ি দিয়ে, ঝোলাঝুলি করতে দেখে একটা টায়ারের যোগাড় করলাম কত কাঠ খড় পুড়িয়ে। ঐ টায়ারকে স্নানের ঘাটের কাছে বট গাছের ডালে,দড়ির সাথে শক্তভাবে বেঁধে, ঝুলানোর উপযোগী করে, নিজের হাতে দোলনা বানালাম তোর জন্য।একবার দোল দেয়ার পর ওটা পেন্ডুলাম ঘড়ির মতো অনবরত সামনে-পেছনে দুলতে থাকলো তোকে নিয়ে। প্রথমে তুই ভয় পাচ্ছিলি। পরে বুঝতে পেরেছিলাম, ওটা তোর অজুহাত। তুই আমাকে নিয়ে দোল খেতে চেয়েছিলি। তোর সাথে দোলাতে বসে, নিজেদের মনে হয়েছিল রাধাকৃষ্ণ।
রাধাকৃষ্ণ এর কথা বলতে মনে পড়লো দোলনা ওপর প্রেমটা কতো পুরাতন। দ্বাপর যুগেও দোলনাই দুলতো রাধাকৃষ্ণ। ঝুলনে আমাদের বাড়িতে এখনো দোলাতে বাসানো হয় রাধা কৃষ্ণকে। যদিও মথুরা-বৃন্দাবনের মতোই বাংলার ঝুলন উৎসবের ঐতিহ্য সুপ্রাচীন। শুধুমাত্র রাধাকৃষ্ণের যুগলবিগ্রহ দোলনায় স্থাপন করে হরেক আচার অনুষ্ঠান উৎসব নয় শুধু এটা, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক তাৎপর্য। শ্রাবণের শুক্লা একাদশী থেকে পূর্ণিমা পর্যন্ত চলে এই উৎসব।
এই উৎসব হয় মূলত বনেদিবাড়ি এবং মঠ-মন্দিরে। তবে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের পাশাপাশি ছোটদের ঝুলন সাজানোর আকর্ষণ হারিয়ে যাচ্ছে আজকাল। আগে বাচ্চা ছেলেমেয়েরা সারা বছর ধরে, সংগ্রহ করতো ছোট ছোট খেলনা, তৈরি করতো শহর গ্রাম, পাহাড় নদী। হারিয়ে যাচ্ছে বোধহয় সেই দিন গুলো। তবে আজও অমলিন হয়ে আছে,নানা ধরনের মাটির পুতুল, কাঠের দোলনা আর গাছপালা দিয়ে ঝুলন সাজানোর আকর্ষণ। কোলকাতা শহরের কিছু বনদী বাড়ির ঝুলন উৎসব হয় এখনো।
তবে জানিস এই ঝুলন উৎসবের একটা আলাদা গুরুত্ব আছে। শাস্ত্রীয়, ভৌগোলিক ও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও রয়েছে। এই অনুষ্ঠানে দোলনাটি দোলানো হয় পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে। সূর্যের উদয় অস্ত ও অবস্থানের দিক নির্দিষ্ট করেই তা করা হয়। সূর্য হচ্ছে পৃথিবীতে সর্ব প্রকার শক্তির উৎস। আর পৃথিবীর গতি হচ্ছে-দু’টো, আহ্নিকগতি ও বার্ষিক গতি। দুই গতিধারায় বছরে দু-বার কর্কটক্রান্তি ও মকরক্রান্তি রেখায় গিয়ে অবস্থান করে। তখন ঘটে সূর্যের উত্তরায়ন ও দক্ষিণায়ন অবস্থান। সেই কারণেই শ্রীকৃষ্ণের দোলযাত্রা অনুষ্ঠানে দোলনাটিকে ঝোলানো হয় উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে।
শ্রাবন মাসে ঝুলন উৎসব হয়। বোধহয় শ্রাবন মাসে ঈশ্বর ও রোমান্টিক হয়ে যায়। সকালে বিকালে দুপুরে কতো দোলা দুলেছি। ঐ দোলনাতে ঘুমিয়ে পড়েছি দুই জনে। পড়ার চাপ কিছুদিন আমরা আলাদা হয়ে গেলাম। তারমধ্যে তুই হঠাৎ করে বড়ো হয়ে গেলি। দুই একদিনের মধ্যেই শহর যেতে হবে । শহরের কলেজ ভর্তি হয়েছি যে। বললাম ” চল দোলনা খেয়ে আসি। অনেক দিন দোলনা খায়নি।”
তুই বললি ” আমরা আর ছোট নেই।”
যাবার সময় একটা চিরকুটে লিখে গেলি দুপুরে এসো। ওসময় ওদিকে কেউ যায় না। ঝিরঝির বৃষ্টি পড়ছে । আগে কখনো হয়নি এমনটা কিংবা হয়তো ভাবিনি তুই বড়ো হয়ে গেছিস। শাড়ির ফাঁক দিয়ে তোর উঁকি মারা পেট, আর মসৃন কোমরটা যেনো হাল্কা আলোটাও ছুঁতে চাইছে, তোর আধ ভেজা শরীর , ফুটে উঠেছে তোর ভেজা শাড়ির মধ্যে, অন্য ভাবে আমাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে।
ইচ্ছে করেই তোর কোমর হাত দিয়ে দোলনা তে তুললাম তোকে। তুই বোঝালি আজকাল আমার ছোঁয়া তোকে অন্য অনুভূতি দেয়। সবকিছু ঠিকঠাক ছিলো হঠাৎ তুমল বৃষ্টি। বৃষ্টি তোকে ভিজিয়ে বলে দিলো, তুই এখন পুরোপুরি একটা মেয়ে হয়ে গেছিস। তোর ভেজা ঠোটের আমন্ত্রণ আমি অস্বীকার করতে পারলাম না। তুই তো আমার কাছে নিজেকে সঁপে দিতে এসেছিলি আজ বুঝলাম। কোনো বাধা দিলি না বরং আদরে আদরে ভরিয়ে দিলি আমায়। পাগল করা একটা নেশা এই প্রেম ভালোবাসা। তবে আমি ও বড়ো হয়েছি। দাড়ি কমা কোথায় দিতে হয় আমি জানি।
তুই চাইছিলি সম্পূর্ণ ভাবে নিজেকে আমার করতে। তোকে বোঝাতে পারলাম সবকিছু হওয়া মানেই সম্পর্ক টিকে থাকবে এমন নয়। সেক্স বা যৌনতা তো সাময়িক উত্তেজনা। কিন্তু দুইজনের মধ্যে জন্মানো অনুভূতি স্মৃতি গুলোই আসল। তাই অন্তিম মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়েছি কারণ এখনো ক্যরিয়ার গড়তে অনেক বাকি। কোনো ঝুঁকি নিতে চাইনি আমি।
তোর শুধু এক কথা “জানি তুমি আমাকে বিয়ে করবে না” সেই থেকে দোলনা টার মতো ঝুলে দুলতে থাকলো আমাদের সম্পর্কটা।
“দোল দোল দুলুনি, রাঙা মাথায় চিরুনি…” মা-ঠাম্মার কোলে শুয়ে সেই চিরন্তন ঘুম পাড়ানি গান ভুলে যাবেন এমন বাঙালি বোধহয় নেই। বৃষ্টিস্নাত বিকেল হোক কিংবা পূর্ণিমার রাত, দোলনায় দুলে কফির মগে চুমুক দিয়ে আলতো আড়মোড়া ভাঙার আমেজটাই আলাদা! কেমন যেন রাজা মহারাজা বোধ হয় নিজেকে, তাই না? দোলনায় দুলে কী অবলীলায় ফিরে যাওয়া যায় শৈশবের সেই দিনগুলিতে। আমি আমার শহরে বাড়িতেও দোলনা লাগিয়েছি । ছাদে, বসার ঘরে। একটা বেতের একটা, দড়ির। বাড়ির রূপটাই বদলে দিয়েছে দোলনা।
এ বাড়ির বাগানেও একটা লাগিয়েছি। তোর মেয়ে একটা দোলনা চেয়েছে আমার কাছে। আমি দোলনা উপহার দিতে খুব খুশি। ও আবার ইংরেজি বলে। একটা হামি দিয়ে বলল ” I love you মামু।”তুই দেখলে খুব খুশি হতিস। কিন্তু কি করা যাবে তুই নেই, আমি আমাদের সেই টায়ার দিয়ে তৈরি করা দোলনা তে দুলতে দুলতে সেই দিনের কথা গুলো ই ভাবছি।
“সেই চিরসবুজ ঘাস,
আজ ফেলছে দীর্ঘ শ্বাস।
দোলনায় দোল খাওয়ার দিনগুলো
আজ স্মৃতির পাতায় ঠাই পেলো,
বিকেল এ বটের ডালে
দোল খেলে রোদ্দুর ছায়া আপন তালে
পড়ন্ত ছায়ায় আপন মনে দোল খেতে খেতে
ঘুম নেমে আসতো চোখে,
যেনো মাথা তখন মায়ের বুকে।
খেলার সাথীর ইশারা পেলে
চুপি চুপি বাহির হতাম ঘর থেকে
সাথীদের দিকে
যেতাম মর্মর শুকনো পাতার উপরে হেটে হেটে,
এখন আর খেলতে কেউ ডাকে না
তবু শৈশবের দিন গুলো মুছা যায় না
হৃদয় থেকে, এখনো তোকে
মনে পরে এই দোলনা টা দেখে।”