ধ্রবতারা
লিখিকাঃ গল্প কন্যা (ছদ্ম নাম)
বেশির ভাগ মেহমানই চলে গেছে।নিকট আত্মীয়রা ছাড়া।জিসানের পরিবার ও চলে যাবে কিন্তু জহির সাহেব আটকে দেন।সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেবেন বলে।
লিভিং রুমে সবার মধ্যে কথা চলছে।এক্সট্রা বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে।তবু ও ছেলেরা দাড়িয়ে আছে।বাড়ির সবাই উপস্থিত এখানে।
ধ্রুবর বড়ো মামা(মতিউর রহমান)সকলের উদ্দেশ্যে বলতে শুরু করেন "আমার কিছু কথা ছিলো।অনুমতি দিলে বলতাম।"
সবাই উৎসুকভাবে তাকিয়েছে ওনার দিকে কথা শুনার জন্য।জহির সাহেব বলেন "বলো কি বলতে চাও।আমরা নিজেরা নিজেরা ই তো অনুমতি চাওয়ার কিছু নেই।"
" দুলাভাই,আসলে আমার বড় মেয়ে রাইসা।ওকে তো চিনেন।কেমন নম্র ভদ্র ঠাণ্ডা সভাবের মেয়ে।ওর সম্পর্কে তো সবই আপনাদের জানা।মেয়ে বড়ো হয়েছে তাই চিন্তা বেরেছে,বিয়ে দেওয়ার কথা ভাবছি।"
কবির সাহেব বলে উঠেন"মতিউর ভাই এটা তো সুসংবাদ।আপনি তো ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন।"
সবাই হেসে উঠে।
মতিউর : হ্যা সুসংবাদ ই।অনেক সম্বন্ধ এসেছে কাউকে গ্রহণ করিনি।
জহির :বলো কি।কেন...?খোঁজ খবর নিয়ে দেখবে না... ভালো হলে তো হতে ও পারে,তাই না।
মতিউর : আসলে ধ্রুব কে আমার খুব পছন্দ।এমন ছেলে এখন লাখে একটা পাওয়া মুশকিল।আমাদের ইচ্ছে ধ্রুবর সাথে রাইসার বিয়ে দিব।সম্পর্কে আরো একটা নতুন সম্পর্ক যোগ হবে। যদি আপনাদের কোনো আপত্তি না থাকে।তাহলে ঘরের মেয়ে ঘরেই থাকলো।মায়ের ও একি ইচ্ছে।আমাদের পুরো পরিবারের মত আছে।সবাই ধ্রুব কে খুব পছন্দ করে।
লিভিং রুমের পরিবেশ থমথমে হয়ে গেছে।টু শব্দটি ও হচ্ছে না।
জহির সাহেব :হুম বুঝলাম।কিন্তু ধ্রুব আর রাইসার মতামতের বিষয় আগে জানতে হবে?
ধ্রুবর নানু : ওর আবার কি মতামত হইবো,বাপ চাচা গো মুখের উপরে কিছু কওয়ার সাহস নাই ওর।ওয় রাজি।আর আমার ও ইচ্ছা,আমার ধ্রুব নানা ভাই রাইসা মণিরে বিয়া কইরা সুখে ঘর সংসার করবো।ঘরের পোলা ঘরে ফিরবো।আমাগো রাইসা মণি আমার ভাইরে আচলে বাইন্ধা রাখবো।তখন এমন দেশে বিদেশে ঘুইরা বেরাইবো না।
ধ্রুব তো অবাকের উপর অবাক হচ্ছে কিভাবে অবলীলায় উনাদের কথা বলে যাচ্ছে।
এই কথা শুনে তুরের মাথা ঘুরছে।মাথা ভেতর কেমন ঝিম ধরে আছে।
ধ্রুবর দাদি(ফজিলাতুন্নেছা ): হ... রাইসা তো খুবোই লক্ষি মাইয়া।আচার আচরণ ও ভালো আছে।প্রস্তাব টা মন্দ না।
জহির সাহেব পড়েছেন বিপাকে ছেলের সাথে কথা না বলে কিভাবে কি বলবে।
মাঝ খান দিয়ে জিসানের বাবা(সরিফ মির্জা) বলে উঠেন "নিজেদের জানা শোনার মধ্যে হলেই ভালো।ছেলে মেয়েদের নিয়ে নিশ্চিত থাকা যায়। সম্পর্ক ও আরো মজবুত হয়। জিসানের জন্যে ও তো আমরা তুরিন মায়ের কথা বলেছিলাম।কিছু তো জানালেন না।"
কবির সাহেব : হ্যা,বলেছেন।তবে,এখনি তুরের বিয়েতে মতামত নেই।পড়াশোনায় আগ্রহী।সামনে পরীক্ষা এখন বিয়ে ঘটিত কিছু হলে রেজাল্ট খারাপ হতে পারে।বিয়ের ব্যাপার কিছু দিন সময় নিয়ে ডিসিশন নিতে চাই।আপনারা ও মেয়ে দেখতে থাকেন।হয়ত তুরের চেয়ে ভালো মেয়ে ও পেয়ে যেতে পারেন।
দাদি:এতো পড়ালেখা কইরা কি করবো।সেই তো বাচ্চা মানুষ করবো ঘর সামলাইবো।যোগ্য পাত্র হাত ছাড়া করোন লাগে না।
সরিফ( জিসানের বাবা ) : বিষয়টা তো আপনাদের আগে ই বলেছি।ধ্রুব ও জানে। আমার ছেলে আপনাদের মেয়েকে দেখেই বিয়ে করতে রাজি হয়।তা না হলে তো রাজি ই হচ্ছিল না।ধ্রুবকে জানিয়ে ছিলাম,ধ্রুব তো জিসানের ব্যপারে সব জানে।
মতিউর : যেহেতু ,সম্ভ্রান্ত পরিবার।ওনারা শিক্ষিত,মার্জিত যথেষ্ট ভালো মনের মানুষ রাজি হয়ে গেলে ই ভালো।পড়াশোনা চাইলে বিয়ের পর ও করতে পারবে।
তুর যেন আকাশ থেকে মাটিতে আছড়ে পড়েছে।জিসান ওর দিকে চোরা চোখে বারবার তাকাচ্ছে।তুর পড়েছে মহা বিপদে।এই ছিলো জিসানের মনে।তবে ধ্রুব আর রাইসার কথা মনে হতে ভেতর থেকে মোচড়ে ধরে।মন কঠিন পদক্ষেপে নিয়ে নেয়।
ধ্রুব বারবার তাকানোর বিষয়টি খেয়াল করছে।সবার কথা শুনে এমনি মেজাজ চড়ে আছে।বড়োদের মাঝখানে কোনো কথা ও বলতে পারছে না।দিনে দিনে সব কিছু কেন এতো কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
এ দিকে ধ্রুবর মা রাজি তিনি তার মতামত জানিয়েছেন।ধ্রুবর নানু রাইসাকে ধ্রুবর পাশে যেয়ে দাড়াতে বলেন।রাইসা লাজুক হেসে মাথা নতো করে তাই করে,ধ্রুবর পাশে গিয়ে দাড়ায়।কয়েক জন ছাড়া সবাই মাশাল্লাহ বলে উঠেন।
কিন্তু তুরের সহ্য হচ্ছে না।ভেতরটা হাজারো ছুরির আঘাতে ঝাঝড়া হয়ে যাচ্ছে।মাথায় প্রচুর যন্ত্রণা হচ্ছে।ঘাড়ে ও ব্যথা শুরু হয়েছে।মনে হচ্ছে এক্ষুণি জ্ঞান হারাবে।ওদের দুজনকে পাশাপাশি আর দেখতে পারছে না।পাশাপাশি দেখেই যদি সহ্য না করতে পারি,বিয়ে করে সংসার করতে দেখবো কিভাবে।তুর উঠে দাড়ায় বাবার উদ্দেশ্যে বলে "বাবা তোমরা যদি ভালো মনে করো তাহলে আমার কোনো আপত্তি নেই।আমি বিয়েতে রাজি"বলে হাটা দিল।
জিসানের চোখ খুশিতে চিলিক দিয়ে ওঠে।জিসানের পরিবারের সবাই খুব খুশি হয়।বাকিরা ও খুশি হয়।সকলে আলহামদুলিল্লাহ বলছেন।এক বারে দুজনের বিয়ে ঠিক হচ্ছে।তবে কয়েক জন খুশি হতে পারে নি।
ধ্রুব হতভম্ব হয়ে গেছে।যেন একের পর এক বাজ পড়ছে মাথায়।তুরের উপর ধ্রুব মারাত্মক লেভেলে রাগান্বিত হয়ে গেছে।আর কতো ভাবে এই মেয়ে কষ্ট দিবে।ধ্রুব এইবার মুখ খোলে।
"বাবা... আমি রাইসাকে বিয়ে করতে পারবো না।"
মতিউর : কেন? ওকে তোমার পছন্দ না?
"বিষয়টা পছন্দের না।ওকে আমি কখনো বোন ছাড়া অন্য চোখে দেখিনি।সেখানে এমন সম্পর্কে জড়ানোর প্রশ্ন ই উঠে না।"
মতিউর : মামাতো ভাইবোনের মধ্যে তো বিয়ে হয়,এটা কোনো নতুন ঘটনা না।তুমি বিষয়টা এতো জটিল করে দেখছো কেন?তুমি সহজ ভাবে নিলে দেখবে খুবই সহজ ব্যাপার।
" দুঃখীত মামা।আমি ব্যাপারটা সহজ ভাবে নিতে পারছি না।আমাদের সম্পর্কে ধারণা নিয়ে আপনার ইচ্ছে পোষণ করা উচিত ছিল।বিশেষ করে আমার প্রতি।"
নানু: তুমি কি কও ভাই এগুলান আমরা কতো আশা কইরা আছি।সেখানে তুমি এমনে সব নষ্ট কইরা দিবা।
"নানু তোমরা এমনই আশা করেছো যেটা আমার পক্ষে কিছুতেই পূরণ করা সম্ভব না।
আমি যেমন বাবা মার ইচ্ছের বিরুদ্ধে যাব না,তেমনি নিজের পছন্দকে ও প্রাদান্য দিব।আর একটা কথা জেনে রাখো,আমি না চাইলে কেউ আমাকে আচলে বাধতে পারবে না।আর রাইসা তো না ই।আশা করি সবাই ক্লিয়ারলি বুঝতে পারেছেন।এটা নিয়ে আর কোনো কথা হবে না।"
নানু: আমার ইচ্ছা রে তুমি এমনে পায়ে ঠেল্লা দিলা।অপমান করলা।তুমি আমার অনেক আদরের নাতি তোমার থেইকা এমনডা আশা করিনাই।তোমার উপরে আমগো অধিকার নাই এডা বুঝইতে চাইতাছো তো।ঠিক আছে এই বিয়া না হইলে আমি কুনো দিন এই বাড়িতে পারা দিমু না।
"এখানে কাউকে অপমান করা হয়নি।আমি আমার মতামত জানিয়েছি।যদি মনে কষ্ট দিয়ে থাকি তার জন্য দুঃখীত।আর এসব তোমাদের নিছক ভাবনা।এসব ভেবে সুন্দর সম্পর্কটা নষ্ট করো না।"বলেই চলে গেছে।
এমুহূর্তে কি বলা উচিত কেউ বুঝতে পারছে না।হঠাত কিছু একটা ভাঙ্গার শব্দ হয়। শব্দ টা উপর থেকে আসে।ধ্রুব সিড়ির কয়েক ধাপ উঠেছিল।শব্দ শুনে দৌড়ে উঠে।দেখে করিডোরের শেষ মাথায় তুর পরে আছে।একটু এদিক সেদিক হলেই গ্রিল ছাড়া খোলা বারান্দা দিয়ে সোজা নিচে পড়তো।পাশে থাকা মাঝারি সাইজের মাটির টবটা ভেঙে পরে আছে।ধ্রুব তুর বলে চিৎকার দিয়ে ওর কাছে যায়।হাটুতে ভর দিয়ে বসে তুরের গালে হাত দিয়ে ডাকছে"তুর...তুর... এই তুর...কি হয়েছে ,চোখ খোল।"
মাথার নিচে হাত দিয়ে কোলে তুলে নেয়।তুরের সেন্স নেই।মাথা ফেটে রক্ত বের হচ্ছে।ততোক্ষণে সবাই এসে পরেছে।তুরের মা মেয়ের এই অবস্থা দেখে কান্নাকাটি শুরু করেছেন।সবাই ওর অবস্থা দেখে হতোভাগ।জহির সাহেব কবির সাহেব মেয়েকে এমন দেখে বিচলিত হয়ে পড়েছেন।রক্ত দেখে ধ্রুবর কোনো হুশ নেই।জিসান পাশে বসে বলে"ধ্রুব ওর মাথা থেকে রক্ত বের হচ্ছে,দ্রুত হসপিটালে নিতে হবে।"
ধ্রুব পাগলের মতো করছে।কারো দিকে কোনো খেয়াল নেই। জিসানের কথায় মাথা থেকে হাত তুলে হাতের দিকে তাকায়,রক্তে পুরো মেখে গেছে।
জহির সাহেব বলেন "এম্বুল্যান্সে কল দেও কেউ।আল্লাহ কি বিপদ।"
একেক জন একেক কথা বলছেন।কিন্তু ধ্রুবর কানে কিছু যাচ্ছে না।ভেতরটা যে যন্ত্রণায় ছারখার হয়ে যাচ্ছে।কোনো কিছু না ভেবে তুরকে কোলে তুলে নেয়।ছোট্ট শরীর টাকে বুকের সাথে ঝাপটে ধরে দৌড়াতে শুরু করে।ধ্রুবর এই অবস্থা দেখে সবাই সাবধানে সাবধানে করছে।এ মুহূর্তে ধ্রুবর কানে কিছু যাচ্ছে না।তুরকে নিয়ে ছুটতে ছুটতে গাড়িতে গিয়ে বসে।জিসান,ফাহিম,মনির ও দৌড়ে যায়।ধ্রুব তুরকে কোলে নিয়ে পেছনে বসে।ফাহিম ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে।ধ্রুব তাড়া দেয়।গাড়ি চলতে শুরু করে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে।জিসান মনির কবির সাহেব ও আসছেন পেছনের গাড়িতে ।
গাড়ির মধ্যে ও ধ্রুব তুরের নাম ধরে ডাকছে।রক্তে পুরো পান্জাবির এদিক ওদিক ভিজে গেছে।চোখ বেয়ে দু ফোটা পানি গরিয়ে পরেছে।প্রেয়সীর রক্তাক্ত অবস্থা দেখে সহ্য করতে পারছে না।
ফাহিম ভাইয়ের ছটফটানি দেখে থমকে গেছে।ও তো জানে ধ্রুব কেমন পাগলের মতো তুরকে ভালোবাসে।
সন্ধ্যা ৭টা,
তুর হাসপাতালের বেডে ঘুমিয়ে আছে।মাথায় ব্যান্ডেজ লাগানো।হাতে স্যালাইন চলছে।কবির সাহেব আর জহির সাহেব কেবিনের সোফায় বসে আছে।বাহিরে ধ্রুব জিসান ফাহিম মনির বসে আছে।
ডক্টর বলেছেন "শরীর খুব দুর্বল।পালসরেট একদম কমে গেছে ৩০/৪০।অতিরিক্ত স্ট্রেস নিচ্ছে হয়তো।তাই সেন্সলেস হয়ে পড়েছে।তাছাড়া ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করে বলে মনে হয় না।বেশ অনেকটা কেটেছে। কিন্তু গভীর না দ্রুত শুকিয়ে যাবে।স্যালাইন চলছে চলুক,ইনজেকশন দিয়েছি।আধাঘণ্টার মধ্যে সেন্স চলে আসবে।আর সেন্স আসলে ও পেশেন্ট ঘুমাবে চাইলে রাতে নিয়ে যেতে পারেন।খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে যত্নবান হবেন।"
ফাহিম মনির জহির আর কবির সাহেব কে জোর করে বাড়ি নিয়ে গেছে।হাসপাতালে শুধু ধ্রুব আর জিসান রয়ে যায়।জিসানকে ও চলে যেতে বলে। কিন্তু তুরের সাথে কথা বলে তারপর যাবে তাই রয়ে যায়।
ধ্রুব চুপ করে বিষন্ন মনে বসে আছে টু শব্দ টি ও করছে না।নিজের হাতে কাপড়ে প্রেয়সীর রক্তের দাগ লেগে আছে দেখে,বার বার শুধু মনে হচ্ছে সকালে কেমন ফুটন্ত গোলাপের মতো লাগছিল।সারাবাড়ি ছোটাছুটি করেছে।কিছুক্ষণের মধ্যে কি হয়ে গেল।হাসপাতালের বেডে অচেতন হয়ে পড়ে আছে।
এভাবে ঘন্টা পার হয়ে যায়।ধ্রুব কেবিনের ভেতরে ঢুকে বেডের পাশে চেয়ার টেনে বসে।একটা হাত নিজের হাতের মুঠোয় নেয়।নেতিয়ে পড়া ঘুমন্ত মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে থেকে বলছে "বার বার শুধু ভুল বুঝে দূরে সরে যাচ্ছো।কখনো কি একটু বুঝার চেষ্টা করবে না।শুধু একটা বার সুযোগ দাও না জান,তোমার মনের সব কষ্ট দূর করে দিবো।এভাবে নিজেকে আর কষ্ট দিওনা।তোমাকে এভাবে দেখে যে আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি।আমার বুকটা যে মরুভূমির মতো খা খা করছে।তোমার কপালে একটা চুমু খেলে কি তুমি রাগ করবে?করলে ও কিছু করার নেই জান"।
বলেই হাতের পিঠে চুমু খায়।ব্যান্ডেজের উপরে কপালে চুমু খায়।
তখনই জিসান রুমে ঢুকে আর এই দৃশ্য দেখে ফেলে... ... ...
চলবে.....