ধ্রবতারা
লেখিকাঃ গল্প কন্যা (ছদ্ম নাম)
ভোর ৪টায় ধ্রুব বের হয়ে গেছে।আজকে ধ্রুবর ফ্লাইট আছে।আসতে আসতে অনেক রাত হবে।ওয়েদার অনুপযোগী হলে বা কোনো কারণে ডিলে হলে।না ও ফিরতে পারে।একেবারে আগামীকাল ফিরবে।
তুরকে জিজ্ঞেস করেছিলো থাকতে পারবে কি না।নাকি ভয় পাবে।তুর ভয় পাবে না জানায়।
ধ্রুবর কিছু করার নেই।এখন শিডিউল চেন্জ করার বা লিভ নিয়ার কোনো উপায় নেই।তাই বাধ্যতামূলক যেতে হয়।
কিন্তু বারবার করে বলে যায়,কেউ আসলে যেন হুট করে দরজা খুলে না ফেলে। লুকিং গ্লাসে দেখে তারপর যেন খুলে।কোনো প্রবলেম হলে কেয়ার
টেকার কে যেন জানায়।খুদা পেলে ফ্রিজে খাবার আছে ,ওভেনে গরম করে খেয়ে নিতে।রান্না ঘরে যেতে হবে না।কোনো রকম কান্না কাটি যেন না করে।এরকম হাজারো উপদেশ দিয়ে বের হয়।
ঘুমে ঢুলু ঢুলু তুরের এক কান দিয়ে সব ঢুকেছে অন্য কান দিয়ে বের হয়ে গেছে।কোনো মতে দরজা বন্ধ করে বিছানায় পড়ে আর ঘুমের দেশে পারি জমায়।
কলিং বেলের আওয়াজে ঘুম থেকে উঠে।চোখ খুলে মোবাইলে টাইম দেখে সাড়ে ১০টা বাজে।তড়িঘড়ি করে উঠে।চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে দরজার লুকিং গ্লাসে চোখ রাখে।
দেখে কেয়ার টেকার চাচা।"আসসালামু ওয়ালাইকুম,কোনো দরকার চাচা।"
"জি মেডাম।স্যার বইল্যা গেছিলো হোটেল থাইকা আফনের নাস্তা টাস্তা আইন্না দিতে।একবার আইসা ফেরত গেছি আফনে মনে হয় ঘুমাইতাছিলেন।"
"হ্যা।ঘুমাচ্ছিলাম।ইসস...আপনাকে কষ্ট করতে হলো।ঘরে তো খাবার ছিলো। শুধু শুধু আপনাকে বলে গেছে।আমি দুপুরে খেয়ে নেবো।আপনাকে কষ্ট করে আর আনতে হবে না।"
"আরে না কষ্টের কি আছে মেডাম।এইডা তো আমার কামই।"
"চাচা আমাকে মেডাম বলে ডাকবেন না কেমন যেন লাগে।আমি আপনার মেয়ের বয়সী।আমার কিছু লাগলে লেন্ড লাইনে কল করে জানাবো।"
"জি আচ্ছা,মামুণি।এই নেন আফনের নাস্তা।ওই রাস্তার পাশের ভালা রেষ্টুরেন্ট থেইকা আনছি।"
"ধন্যবাদ,চাচা। কতো হয়েছে?"
"স্যার দিয়া গেছে মামুণি।আফনের চিন্তা করা লাগবো না।আমি বিল দেওয়ার কাগজটা রাইখা দিছি।স্যার আইলে বুঝাই দিমু।আফনের কিছু লাগলে খালি বলবেন।আসি মামুণি।"
"জি চাচা।"
ফ্রেশ হয়ে অল্প খাবার খায়।সকাল বেলায় খাবারটা সব সময় বাবা না হয় বড়ো আব্বুর প্লেট থেকে উনাদের হাতেই খেত।না হয় যে ওর পেট ই ভরতো না।
এসব ভাবতে ভাবতে আর গলা দিয়ে খাবার নামেনি।বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবছে "কোনো দিন কল্পনা করতে পারেনি ও ওর বাবা মায়ের সন্তান না।অন্য কারো সন্তান।এখন বুঝতে পারছে।এ জন্যই ছোট বেলা থেকে এতো মানুষ ওকে এতো কথা শুনাতো।ওকে সহ্য করতে পারতো না।ওর আহ্লাদীপনা দেখে মুখ ভেংচাত। তাই হয়তো এতো আত্মীয়ের চোক্ষুশূল ও।হয়তো রাস্তার মানুষ হয়ে রাজপ্রাসাদে থাকার দরুন এমন ভাবনা তাদের।ওদের আর কি দোষ,দোষ তো আমার কপালের।না হয় যে জন্ম দিলো তার কাছে কেন থাকতে পারলাম না।কেন বা এই বাবা মায়ের ঔরসজাত সন্তান হলাম না।কেন এমন দয়ার জীবন পেতে হলো।এমন দয়ার জীবনের জন্য ধিক্কার তোকে তুর।"এসব ভাবতে ভাবতে কান্নায় ভেঙে পড়ে।
চিৎকার করে কাঁদছে"বাবা... ... বাবা ..... আমি যে দুই দিন ধরে তোমার হাতে খেতে পারি না।বাবা...তোমার মেয়ের যে পেট ভরে না।
মা....ও মা ...কিভাবে তোমাদের ছাড়া থাকবো আমি।কে আমার চুল আচড়ে দিবে।দেখো না আমার চুলের কি অবস্থা হয়েছে মা....।ও মা...তোমার মতো করে কে আমার খেয়াল রাখবে। আল্লাহ কেন তোমার পেটে আমার জন্ম দিলো না।তুমি চিন্তা করো না মাড়।কোনো দিন তুহিনকে কষ্ট দিব না আমি।ওর কোনো কিছুতে ভাগ বসাতে যাব না।কোনো দিন ওকে হিংসা করবো না।দুস্টুমি করে ও মারবো না মা।মা... আমার খুব কষ্ট হচ্ছে তোমাদের ছাড়া থাকতে।আল্লাহ... আমার কারণে এই পরিবারের কোন সম্মানহানি করো না।কারো কোনো ক্ষতি কোরো না।আল্লাহ আমার জীবনের বিনিময়ে হলেও সবাই কে ভালো রাখো।"একলা ঘরে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ে।
ও বাড়িতে রায়লা বেগম কবির সাহেব ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করছে না।ওনারা তো জানেন কতো আকাঙ্ক্ষার আর আদরের সন্তান তুর।
এ বাড়ির প্রাণটা ই যেন চলে গেছে। পুরো বাড়ি কেমন নিরব হয়ে আছে।
কবির সাহেব একে বারে দুর্বল হয়ে গেছেন মেয়ের চিন্তায়।"কি থেকে কি হয়ে গেল।আমার মেয়ের ছোট্ট কোমল মনটা ভেঙে গুড়িয়ে গেল।"
বিছানায় শুয়ে শুয়ে রায়লা বেগম কাঁদছেন।কবির সাহেব নিজেকে শক্ত করে বলেন"কেঁদো না তুরের মা।অভিমান কমলে ও ঠিক চলে আসবে।"
রায়লা বেগম বেগম কাঁদতে কাঁদতে বলেন"আসবে না....।এটুকুনি মেয়েটার মনটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে।এ বয়সে কতো বড়ো একটা ধাক্কা সইতে হচ্ছে।আমরা পারলাম না ঢেকে রাখতে।আম্মা প্রথম থেকে ই ওকে পছন্দ করেনি।আজ এটা কি করলো।আমার মেয়ে কে আমার বুকে এনে দেও।ও যে নিজে নিজের যত্ন নিতে পারে না।নিজে চুল বাধতে পারে না। তোমার আর ভাইজানের হাতে না খেলে ওর পেট ভরে না।দুটো দিন ধরে মেয়েটা আমার পিছে ঘুরে ঘুরে বায়না করে না।আমার সোনাটাকে এনে দেও আমার বুকে।আমি একজন ভালো মা হয়ে উঠতে পারিনি।পারিনি ভালোবাসা দিয়ে ওকে আগলে রাখতে।"
"এভাবে ভেঙে পড়ো না।নামাজ পড়ে দোয়া করো।আল্লাহ দেখছেন সব কিছু।উনি সব ঠিক করে দিবেন।বিশ্বাস রাখো।উনি যা করেন সব ভালোর জন্য করেন।কাঁদতে হলে আল্লাহর কাছে কাঁদো।উনি চাইলে কেউ কোনো ভাবে আমাদের মেয়েকে দূরে রাখতে পারবে না।"
তুহিন ও বোনকে ছাড়া ভালো নেই।বোন কে ও কতো ভালোবাসে বোনের অনুপস্থিতিতে বুঝতে পারছে।"আপু তুমি ফিরে এসো।আমি তোমার সব কথা শুনবো।আর কখনো তোমার সাথে মারামারি করবো না চুলে ধরবো না।আমার চকলেট আইসক্রিম গুলো থেকে তোমাকে অর্ধেক দিয়ে দিব।আপু তুমি চলে আসো।আই মিস ইউ সো মাচ।"
ঠিক মতো খাচ্ছে না,খেলছে না। টিভি দেখা গেম খেলা সব কিছু বন্ধ করে দিয়েছে।শাহানা বেগম বাড়ির কাজের লোকদের পর্যন্ত হাতে কোনো কাজ উঠছে না।
জহির সাহেব এক মাত্র আদরের মেয়ের চিন্তায় আর বাড়ির এ পরিস্থিতি দেখে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।তার উপর আত্মীয় স্বজনদের জানাজানির পর তো আরো টিকা যাচ্ছে না।
কেউ ফোন করে,কেউ বাড়ি বয়ে নানা কথা শুনিয়ে যাচ্ছে।
"কি ব্যাপার শুনলাম মেয়ে নাকি বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে? দেখ গিয়ে প্রেমিকের সাথে পালিয়েছে নাকি?"
কেউ আবার বলছে "আগেই বলেছি পর পর ই হয়।রক্ত রক্ত ই হয়।ঠিক ই তো এতো দিন আদর আহ্লাদ দিয়ে লালন পালন করেছ।বড়ো হয়ে এখন নিজের সুখের সন্ধানে চলে গেছে। ফিরে ও তাকাবে না।"
কেউবা বলছেন"এটা তো উছিলা দিয়ে বের হইছে যেয়ে দেখ আজকালকার যুগের মেয়ে যেভাবে স্বাধীনতা দিয়ে আহ্লাদ দিয়ে রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে বড়ো করেছো।কার না কার সাথে ভেগেছে।ক'দিন পর ফষ্টিনষ্টি করে ঘুরে ফিরে ফেরত আসবে।"
এক বুযুর্গ মহিলা আত্মীয়া তো লিমিট ক্রস করে ফেলেছেন।বাড়ি বয়ে এসে বলে গেছেন "আগেই কইছিলাম তুমগো।কার না কার পাপের ফসল ঘরে আনছো।মুখে চুন কালি না লাগায়।দেহ আইজকা আমার কথা সত্যি হইছে।অবৈধ কোনো কিছু ভালো হয় নাকি।যেমনডির ঘরেতেন অমনডি হয়।এতো দিন তো তুমগো ছায়ায় থাইকা বড়ো হইয়া লাইন ঘাট ঠিক করছে।এহন কাঁচ কলা দেহাই গেছেগা।আগে যদি বুঝতা।এতো কানদন কানদন লাগত না।"
জহির সাহেব ক্ষেপে গেছেন।"সুযোগ পেয়ে অনেক বলেছেন।কেমন আত্মীয় আপনারা সান্ত্বনা দেওয়ার জায়গায়।লবণ মরিচের প্রলেপ দিতে এসেছেন।কে বলেছে আসতে।কোনো মানুষ সম্পর্কে জেনে না জেনে এমন নিচু ভাবনা কি করে ভাবতে পারেন।আপনাদের মতো এমন আত্মীয় থাকার চেয়ে না থাকা অনেক ভালো।আসতে পারেন।"
"আমার লগে দূর ব্যবহার কইরা আমার মুখ বন্ধ করবা।দশ জনের মুখ কেম্নে বন্ধ করবা।এক জারজ মাইয়া আনছে বাড়িত।ওই মাইয়া সব ধংশ কইরা দি....."
সমির সাহেব "চুপ থাকেন... বেরিয়ে যান বাড়ি থেকে। আর কখনো যেন এই বাড়ির আশেপাশে না দেখি।"
চলবে.....