ধ্রবতারা লেখিকাঃ গল্প কন্যা (ছদ্ম নাম)
আজ ভোর থেকে ধ্রুবর ফ্লাইট ছিলো।টানা বারো ঘন্টা আকাশে থাকতে হয়েছে।খুবই ক্লান্ত অনুভব করছে।বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় আটটা বেজে গেছে।
এপার্টমেন্টের প্রত্যেকটা ফ্লোরে একটা করে ফ্ল্যাট।ধ্রুবর ফ্ল্যাটে ও না থাকায় কোরিডোরের লাইটটা অফই আছে।বাইরের আলোতে যেটুকু দেখা যাচ্ছে তাতেই ফ্ল্যাটের দরজা অনুমান করে এগোচ্ছে।এমন সময় ফোনটা বেজে ওঠে।
পকেট থেকে ফোন বের করে দেখে ফাহিম ফোন করেছে।
রিসিভ করে কানে ধরে"কেমন আছিস?"
"ভালো না ভাইয়া "
" কি হয়েছে? "
"তুর রাগ করে বাসা ছেড়ে চলে গেছে।"
বিচলিত হয়ে যায় "কি বলছিস?এমন কি হয়েছে যে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে!"
ফাহিম পুরো ঘটনা খুলে বলে।ধ্রুব প্রচন্ডভাবে উওেজিত হয়ে যায়।মুহূর্তে প্রেয়সীর চিন্তায় ব্যকুল হয়ে পড়ে।
"আচ্ছা আমি আসছি।"
কথা বলতে বলতে লিফটের সামনে থেকে এগিয়ে দরজার কাছে যায়।সঙ্গে সঙ্গে কিছু একটার সাথে হোচট খায়।
ফোনের লাইট জেলে দেখে কেউ একজন দরজায় হেলান দিয়ে বসে আছে।দ্রুত সুইচ টিপে করিডোরের আলোটা জালিয়ে দেয়।
দেখে এলোমেলো অবস্থায় দরজায় হেলান দিয়ে তুর ঘুমিয়ে আছে।বুঝতে বাকি নেই সকাল থেকে এখানে অপেক্ষা করছে।অপেক্ষা করতে করতে এখানেই ঘুমিয়ে পড়েছে।
পাশে বসে ডাকে "তুর..."
চোখ মেলে তাকায় "এসেছেন...। দরজা খুলুন আমার খুব খুদা পেয়েছে।"
ধ্রুব হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারছে না। একে খুজতে খুজতে সকলের নাজেহাল অবস্থা।সারা বাড়িতে মরা কান্না চালছে।সকলে মিলে সারা দুনিয়া চষে বেরাচ্ছে। আর মহারাণী এখানে ঘরের দরজায় বসে আছে।
দরজা খুলে ধ্রুব প্রবেশ করে পিছন পিছন তুর।জানালা দরজা বন্ধ থাকায় ভ্যাপসা গরম হয়ে আছে।
ধ্রুব রুমের জানালা গুলো খুলে দেয়।হুরহুর করে বাতাস ঢুকে মুহূর্তেই ঘর ঠান্ডা হয়ে গেছে।
তুর ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে বলে "কোন রুমে যাবো?"
ধ্রুব তাকিয়ে আছে বিশ্বাস করতে পারছে না। এতো বড়ো চমক ওর জন্য রাখা ছিলো।
"বলছি কোন রুমে যাবো? "
ধ্রুব ভাবনায় মজে আছে।তুর কথার জবাব না পেয়ে সোজা ধ্রুবর বেড রুমে ঢুকে যায়।হ্যান্ড ব্যাগটা রেখে গা থেকে ওড়নাটা খুলে বিছানায় হেলান দিয়ে বসে।তাড়াহুড়োয় হাতের কাছে থাকা একটা গ্যান্জি আর প্লাজো ঢুকিয়ে ছিলো ব্যাগে।মোবাইলের চার্জার টা ও আনতে মনে নেই।
বাইরে বসে থেকে ঘেমে একাকার গেছে।গোসল না করা অবদি সস্থি পাচ্ছে না।বিছানায় ওড়নাটা রেখে ব্যাগ থেকে কাপড় গুলো নেয়।হ্যাংগার থেকে ধ্রুবর তোয়ালে টা নিয়ে বাথরুম ঢুকে।
এদিকে ধ্রুব ইউনিফর্ম খোলার কথা ও ভুলে গেছে।সারাদিনের ক্লান্তি কোথায় যেন উবে গেছে ওর।এক অন্য রকম প্রশান্তি অনুভব করছে।
ফাহিম কে কল করে বলে "সবাই কে টেনশন করতে বারণ কর।ও সেফ জায়গায় আছে।আমার বাসায় ।এখনি কিছু বলার দরকার নেই।আগে দেখি কতটা বুঝাতে পারি।ঠিক আছে ......। সামাল দিতে পারবি তো?"
"জি.... জি ভাইয়া।"
ধ্রুব অনলাইনে খাবার অর্ডার করে।সব তুরের পছন্দের খাবার।
কতটা অধিকার নিয়ে বলেছে "খুব খুদা পেয়েছে।"
ফ্রেশ হওয়ার জন্য উঠে।ওর রুমে গিয়ে বুঝতে পারে মেডাম এই রুমেই আছে।কাবার্ড থেকে টাউজার টিশার্ট নিয়েছে বের হবে।তখনই তুর টিশার্ট প্লাজো পড়ে চুলে ধ্রুবর তোয়ালে পেঁচিয়ে বের হয়।সদ্য ভেজা শরীরে টিশার্টটা একদম লেপ্টে আছে।তুর তাৎক্ষণাত উল্টো ঘুরে যায়।
ধ্রুব রুম ছেড়ে অন্য রুমে চলে যায়। ফ্রেশ হয়ে লিভিং রুমে বসে।কিছুক্ষণ পরে খাবার চলে আসে।টেবিলে খাবার সার্ফ করে তুরকে ডাকে।
তুর সব গুলো খাবার খুটেখুটে খাচ্ছে।মুখ দেখে মনে হচ্ছে তৃপ্তি পাচ্ছে না।
প্রেয়সীর দিকে তাকিয়ে আছে।সারাদিন কতোটা খুদা পেটে কাটিয়েছে।কেন যে আর একটু আগে এলাম না।
খাওয়ার পর তুর চুপচাপ চলে যায়।ধ্রুব ও কিছু বলেনি।
___________
সকাল আটটায় তুরের ঘুম ভাঙে।মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে কল আসতে আসতে চার্জ শেষ হয়ে বন্ধ হয়ে গেছে।চার্জে লাগানো প্রয়োজন।
ফ্রেশ হয়ে ধ্রুবর রুমে যায়।দরজা খোলা ই আছে তবু ফরমালিটি রক্ষার্থে।
নক করে "আসবো"।
ধ্রুব বিছানায় হেলান দিয়ে ফোন টিপছিলো।তুরের দিকে তাকিয়ে "আয়......।কিছু বলবি?"
"আমার ফোনের চার্জ শেষ।আপনার চার্জার টা লাগবে।"
"ডেস্কের উপরে আছে।চার্জে লাগিয়ে আয়,খাবি...।"
"যাচ্ছি... "
চার্জে লাগিয়ে বের হবে।
পেছন থেকে ধ্রুব ডেকে উঠে "তুর...। তোর সাথে আমার কথা আছে।"
"কি বলবেন বলেন।দয়া করে ও বাড়ি যেতে বলবেন না।তাহলে এখান থেকে ও চলে যাব।"
"খাবার পর ,বারান্দায় বসে বলি।"
দুজনেই খেতে শুরু করে। খাবার বলতে ব্রেড,ডিম পোস,পিনাট বাটার,কফি।
"সকাল সকাল অন্য কিছু রেডি করতে পারি না।কষ্ট করে খেয়ে নে।"
"এগুলো আমি খেতে পারি।সমস্যা নেই।"
খাবার শেষে ধ্রুবর বেড রুমের খোলা বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে।দুজনে মুখোমুখি।
তুর নিচের দিকে তাকিয়ে আছে।ওর মা ওর নিজের মা না। ওর বাবা ওর নিজের বাবা না।ভাই ওর নিজের ভাই না।এই পরিবারের কারো সাথে কোনো রক্তের সম্পর্ক নেই।সত্যিই কি ও কারো অবৈধ সন্তান।দাদির আর ছোট চাচির কথা গুলো মনে হচ্ছে।এই রায়হান পরিবারের দয়ায় বেঁচে আছে।এই কথা গুলো ভাবতেই চোখে পানি চলে আসে।
"তোকে কিছু কথা বলবো।জানি না কথা গুলো কিভাবে নিবি।"
"কিভাবে নেয়ার কি আছে, যেভাবে বলবেন সে ভাবেই নিব"
"চাচা চাচি কে ভুল বুঝিস না।আসলে ওনাদের পরিস্থিতি এমন ছিলো যে তোকে ওনাদের এডপ্ট করতে হয়েছে।"
"যদি ওনাদের পরিস্থিতি সাভাবিক হতো তাহলে তো আমাকে এডপ্ট করতো না,তাই না?তখন আমি রাস্তায় বড়ো হতাম।রাস্তার মানুষের মতো।রাস্তা থেকে তুলে এনে আমাকে আপনারা দয়া করেছেন।আপনাদের পরিচয় দিয়েছেন।আমি কৃতজ্ঞ আপনাদের ওপর।"
"কি আবোল তাবোল করছিস।কিসের দয়া কিসের রাস্তার মানুষ?আজাইরা কথা ।"
"আপনার কাছে আজাইরা মনে হবে।আমার জায়গায় আপনি হতেন তাহলে বুঝতে পারতেন।এসব কথা বাদ দিন।আপনি চাইলে এখান থেকে ও চলে যাবো।"
"আমি কি তোকে যেতে বলছি।কার ওপর অভিমান করছিস।নিজের বাবা মায়ের উপর।নিজের পরিবারের উপর।যারা ছোট বেলা থেকে বুকে আগলে রেখে বড়ো করেছে। আজকে যে সবাই কষ্ট পাচ্ছে তোর জন্য।আত্মীয় স্বজনরা সবাই নানা কটুক্তি করছে।মেঝো চাচার কতো সুনাম উনার প্রফেশনাল সাইডের লোক জানাজানি হলে তো উনি আরো কথা শুনবে আরো ভেঙে পরবে।তখন সইতে পারবি,দেখতে পারবি পরিবারের অবনতি?"
তুর দু'হাতে মুখ চেপে হাউমাউ করে কাঁদছে।ধ্রুব ওর কষ্টটা বুঝতে পারছে।ওর চোখে পানি দেখে হৃদয়ে রক্ত ক্ষরণ হচ্ছে।উঠে তুরের কাছে যায়।
মাথায় হাত বুলিয়ে বলে"বোকা মেয়ে কাঁদছিস কেন?কাঁদিস না।সব ঠিক হয়ে যাবে।আমি জানি তো তুই সবাই কে কতো ভালোবাসিস।কাঁদিস না।"
কষ্টের সময় আদুরে স্পর্শ পেলে নাকি কষ্ট আরো বাড়ে।আরো দুবর্ল হয়ে পড়ে।তেমনি তুরের ভিতরের কষ্টটা আদুরে স্পর্শে দ্বিগুণ হয়ে উঠে।তুর আচমকা ধ্রুবর কোমর জড়িয়ে ধরে।আর ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে থাকে।
ফুপাতে ফুপাতে বলে"আমি চাই না ভাইয়া...,আমার জন্য পরিবারের সম্মানহানি হোক।বাবা ,বড়ো আব্বু ,মা কারো কষ্ট সহ্য করতে পারবো না।কিন্তু আমি এটাও চাই না তুহিনের সাথে আমার কোনো মনোমালিন্য হোক।দূরত্ব তৈরী হোক।আমি ওর কোনো কিচ্ছুতে ভাগ বসাতে চাই না ভাইয়া।আমার কিচ্ছু চাই না।সবাই এটা নিয়ে খুব চিন্তিত।মা এটা নিয়ে খুব ভয়ে আছে।সেদিন আমি যখন কাগজ পত্র গুলো দেখে ফেলি তখন বলেছে।সেদিন মা আমাকে মিথ্যা বলেছে।আমি যাব না ভাইয়া। প্লিজ আমাকে যেতে বলবেন না।আমি চাকরি করবো।আপনার বোঝা হয়ে থাকবো না।চলে যাবো। দয়া করে এখন যেতে বলবেন না প্লিজ। কেউ যে নেই আমার।কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই।"
তুরের গরম নিশ্বাস ধ্রুব পেটে লাগছে।টিশার্ট ভেদ করে করে যেন শরীরের লোমকূপে ছড়িয়ে পড়ছে।ঠোঁট নাড়িয়ে কথা বলার দরুণ বারবার পেটে স্পর্শ হচ্ছে।ধ্রুবর শরীর ঝিম ধরে গেছে।মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না।কি বলবে একে।
বহু কষ্টে বলে"আমি বলেছি তোকে যেতে।কে বলেছে কেউ নেই তোর আমি আছি।বাবা মা সবাই আছে।আমি থাকতে তোকে কাজ করতে হবে কেন?কান্না বন্ধ কর।যত দিন ইচ্ছে থাক কেউ কিছু বলবে না।এসব কান্না কাটি আজাইরা কথা বার্তা চলবে না। ঠিক আছে।"
চোখের পানি মুছে দেয়। মুছে দিয়ে দ্রুত এ স্থান ত্যাগ করে। ওকে কি বুঝাবে নিজের ভিতর ই উলোটপালোট হয়ে গেছে।
চলবে.....